এতক্ষণ যতগুলি ঘর সে দেখেছে তাদের মধ্যে এই ঘরটিই সবচেয়ে সুন্দর আর উজ্জ্বল। নানা বর্ণে চিত্রিত দেওয়াল আসবাবপত্রগুলি ভারী-ভারী রুপোর তৈরি। বিরাট-বিরাট দুটো চুল্লির মাঝখালে বিরাট পর্দা ঝুলছে। সেই পর্দার ওপরে টি আর ময়ূরের ছবি। মেঝেটা সমুদ্রের মতো সবুজ ওনিক্স পাথর দিয়ে মোড়া। সেই চকচকে মেঝেটা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। হঠাৎ সে লক্ষ করল ঘরে সে একা নেই। দরজার সামনে যে ছায়া পড়েছে তারই আড়ালে দাঁড়িয়ে বেঁটে চেহারার একটা লোক তাকে লক্ষ করছে। তার বুকটা দুরুদুরু করে কেঁপে উঠল; তার ঠোঁটের ভেতর থেকে আনন্দের ধ্বনি ফুটে বেরোল। সে রোদের মধ্যে এসে দাঁড়াল। সে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট লক্ষ করল সেই মূর্তিটাও বেরিয়ে এসেছে।
রাজকুমারী! না, না। এ একটা রাক্ষস। এরকম কিম্ভুতকিমাকার দৈত্য জীবনে সে আর কোনোদিন দেখেনি। অন্য সব মানুষের মতো তার দেহ পুষ্ট নয়; তার পিঠের ওপরে বিরাট একটা কুঁজ; তার পাগুলো বাঁকা; মাথার ওপরে বিরাট বিসদৃশ মাথা; আর টিকিতে একঝাঁক কালো চুল। তাই দেখে আমাদের বামনটি বিষ্ণায় তার ভুরু কোঁচকাল; দৈত্যটাও তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল তার। সে হাসল, তাই দেখে মূর্তিটা হাসল। সে দু’পাশে হাত দুটো ছড়িয়ে দিল। সেই দৈত্যটাও অনুকরণ করল তাকে। সে মুখ ভেঙল, দৈত্যটাও তাকে ঠিক একই ভাবে মুখ ভেঙাল। সে তার দিকে এগিয়ে গেল, দৈত্যটাও এগিয়ে এল তার দিকে।
বামনটি যে কটা পা এগোল, দৈত্যটাও গুণে-গুণে সেই কটা পাই এগোল। সে থামল, দৈত্যটাও থেমে গেল। আনন্দে চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরার জন্যে সে হাত বাড়াল। দৈত্যটাও তার হাতটা ধরলা একেবারে ঠান্ডা কনকনে হাতা ভয় পেয়ে সে তার হাতটা সরিয়ে নিল, দৈত্যটাও সরিয়ে নিল তার হাত। সে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু শক্ত আর মসৃণ একটা জিনিস তাকে বাধা দিল। দৈত্যের মুখটা একেবারে তার মুখের ওপরে এসে পড়েছে। ভয়ে সে। কাঁপতে লাগল। চোখের ওপর থেকে হাতে করে সে তার চুলগুলি সরিয়ে দিল। দৈত্যটাও তাকে অনুকরণ করল। সে দৈত্যটাকে থাপ্পড় মারল, দৈত্যটাও থাপ্পড় মারল তাকে। সে পিছু হটে এল-দৈত্যটাও পিছিয়ে গেল।
কী ওঠা? এক মুহূর্ত চিন্তা করে সে ঘরের চারপাশে তাকাল। কী অদ্ভুত ব্যাপার! সেই অদৃশ্য পরিচ্ছন্ন জলস্তম্ভের মধ্যে ঘরের প্রতিটি জিনিসই প্রতিবিম্বিত হয়েছে। হ্যাঁ, প্রতিটি জিনিসেরই প্রতিফলন পড়েছে–প্রতিটি জিনিসেরই।
এটা কী তাহলে প্রতিধ্বনি? একবার পাহাড়ি উপত্যকায় সে এই প্রতিধ্বনিকে ডেকেছিল–প্রতিধ্বনি তার প্রতিটি কথারই উত্তর দিয়েছিল। মানুষের স্বরের মতো তার দেহটাকেও কি সে ব্যঙ্গ করতে পারে? এটা কি তাহলে?
সে চমকে উঠল। বুকের ওপর থেকে শ্বেত গোলাপটা তুলে নিয়ে চম খেলা দৈত্যটারও লিডের একটা গোলাপ ছিল। পাপড়িতে-পাপড়িতে একেবারে একা সেও সেই রকম চুমু খেল, আর বীভৎস অঙ্গভঙ্গি সহকারে ফুলটাকে সে নিজের বুকের ওপরে চেপে ধরল।
সত্যটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে নৈরাশ্যের একটা বিরাট আর্তনাদ করে সে মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়ে ফোঁপাতে লাগল। তাহলে সে নিজেই এই রকম বীভৎস আর বিকলাঙ্গ? তার পিঠের ওপরেই কুজ রয়েছে দেখতে সেই কিম্ভুতকিমাকার! সে নিজেই তাহলে দৈত্য; আর তবে দেখেই তাহলে ছেলেমেয়েরা ওইরকম হাসছিল। আর সেই রাজকুমারী! সে মনে করেছিল রাজকুমারী তাকে ভালোবাসে কিন্তু সে-ও তো তাহলে তাকে ব্যঙ্গ করেই হাসছিল। তার সেই বিকৃত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে রসিকতা করছিল! তারা তাকে বলেই রেখে এল না কেন? বলে তো কোনো আয়না নেই। তার বাবা তাকে মেরে না ফেলে তাকে এইভাবে বিক্রি করে দিল। কেন? তার চোখ দুটো গরম জলে ভরে উঠল। শ্বেত গোলাপটিকে সে ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে, দৈত্যটাও ঠিক সেই রকম পাপডিগুলো একটা একটা করে ছিঁড়ে মেঝের ওপরে ছড়িয়ে দিল। পাচ্ছে তার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায় এই ভযে চোখে হাত চাপা দিয়ে আহত, পশুর মতো ছায়ার দিকে গুঁড়ি দিয়ে সে এগিয়ে গেল, তারপরে ফোঁপাতে লাগল।
ঠিক সেই মুহূর্তে মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে দলবল নিয়ে রাজকুমারী সেইখানে এসে হাজির হল। তারা দেখল সেই কুৎসিত খুদে বামনটি মেঝেতে শুয়ে খুব জোরে জোরে আর বিস্ময়কর ভাবে মেঝের ওপর ক্রমাগত ঘুষি মেরে চলেছে। এই দেখে তারা সব আনন্দে হো-হো কর হেসে উঠল। তারপরে তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার খেলা দেখতে লাগল।
রাজকুমারী বলল–কী হাসির নাচ দেখ! কিন্তু ওর অভিনয় আরো হাসির। ওকে দেখলে ঠিক মনে হবে ও যেন একটা পাপেট; তবে ঠিক পাপেট-এর মতো স্বাভাবিক নয়।
এই বলে তার সেই পাখাটা হাওয়া খাওয়ার ভঙ্গিতে লাডিযে সে হাততালি দিল।
কিন্তু সেই খুদে বামনটি ওপরের দিকে তার মুখ আর তুলল না। তার ফোঁপানি ধীরে ধীরে মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে এল। তারপরে সে একটা অদ্ভুত রকম মূখব্যাদান করে নিজের দেহটাকে হাত দিয়ে জাপটে ধরল; আবার সে পড়ে গেল তারপরে সব চুপচাপা।
একটু থেমেই চিৎকার করে উঠল রাজকুমারী-বহুত আচ্ছা। কিন্তু এখন তো তোমাকে নাচতে হবে।
শিশুরা চিৎকার করে সমর্থন জানাল তাকে–হ্যাঁ, নিশ্চয়। ওঠ নাচবে চল। কারণ বারবারি বাঁদরের মতোই তুমি চতুর এবং বেশি হাস্যকর।