এই বলেই উদ্ধত ভঙ্গিতে নাক উঁচিয়ে দিল তারা। কিছুক্ষণ পরে বামন যখন ঘাস থেকে উঠে প্রাসাদের অলিন্দের দিকে এগিয়ে গেল তখন তারা খুব খুশি হয়ে উঠল। তারা। বলল–যাবজ্জীবন ঘরের মধ্যে ওকে বন্দী করে রাখা উচিত। পিঠের ওপরে কুঁজ আর বাঁকা। পাগুলির দিকে ওর একবার তাকিয়ে দেখ-রামশ্চন্দ্র, রামশ্চন্ত্র।
কিন্তু বামনটি এত সব কথার কিছুই জানতে পারল না। পাখি আর টিকটিকিদের সে খুবই ভালোবাসত। তার কাছে ফুলগুলি ছিল বিশ্বের অপরূপ সুন্দর–অবশ্য এক রাজকুমারী ছাড়া। সে তাকে সেই সুন্দর লাল গোলাপটি দিয়েছে এবং সে তাকে ভালোবাসে। এটাই তো সবচেয়ে বড়ো কথা রাজকুমারীর কাছে ফিরে গেলে কতই না খুশি হত সে। ডান হাতের ওপরে তাকে বসিয়ে রাজকুমারী তার দিকে চেয়ে হাসত। সে তাহলে রাজকুমারীকে তার খেলার সঙ্গী করে নিতে পারত, অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত খেলা শেখাতে পারত তাকে। কারণ এর
আগে যদিও সে কোনোদিন প্রাসাদে আসেলি তাহলেও সে অনেক বিস্ময়কর কাজ করতে জানে। ফড়িংরা যাতে গান করতে পারে সেই জন্যে শরগাছ দিয়ে সে বেশ ছোটো ছোটো খাঁচা তৈরি করতে পারে। তৈরি করতে পারে তললা বাঁশের বাঁশি। সে প্রতিটি পাখিরই ডাক জানে; আর নানা জায়গা থেকে নানা পাখির স্বর নকল করে তাদের ডাকতে পারে। ঋতুর পরিবর্তনে অরণ্যভূমিতে যে সব বিভিন্ন নাচ শুরু হয় তার সব কাটাই তার মুখস্থা বুনো পায়রা কোথায় বাসা বাঁধে তাও তার অজানা নয়। একবার একটা ব্যাধ দুটো পায়রাকে জাল পেতে ধরে নিয়ে গেল। তাদের বাচ্চাগুলোর কী দুর্দশা! সে তাদের নিয়ে এসে একটা বাসা তৈরি করে দিল। তারা বেশ পোষ মেনে গিয়েছিল। প্রতিদিন সকালে তারা তার হাত থেকে খাবার। খেয়ে যেত। রাজকুমারীরও ভালো লাগবে তাদের। ভালো লাগবে কাঁটার মতো লম্বা। ঠোঁটওয়ালা ডে পাখিদের, বন্য শুয়োর আর বিত্ত মন্থরগতি কচ্ছপদের যারা বনের মধ্যে ঘাড় দুলিযে-দুলিয়ে হাঁটে আর কচি-কচি পাতা ঠুকরে-ঠুকরে খায়। নিশ্চয়, বনের মধ্যে গিয়ে তার সঙ্গে খেলতে তাকে হবেই। সে তাকে তার ছোট্ট বিছানার একপাশে শুতে দেবে। যাতে কোনো বন্য ডানোয়ার তার বিছানার কাছে আসতে না পারে সেই জন্যে সারারাত জেগে সে পাহারা দেবে। সকাল হলে সে তাকে ভাগাবে; তারপর সারাদিন দুজনে তারা বনের মধ্যে নেচে নেচে বেড়াবে। মাঝে মাঝে সাদা খচ্চরের উপরে চড়ে পাদরি বই পড়তে পড়তে সেদিকে আসবে, আর আসবে জমকালো পোশাক পরা শিকারির দল। মদ তৈরি করার সময় আঙুর। ফলের ব্যবসাদাররা আসবে, হাত-পা তাদের লাল রঙে মাখা; কাঁধের ওপরে ভিস্তি, সেই ভিস্তি থেকে চুইযে গড়িয়ে পড়বে মদের ফোঁটা। বনবাসীরা বনের মধ্যে চারকোল পোড়াবে; ডাকাতরা গুহা থেকে বেরিয়ে তাদের অব লুটপাট করে নিয়ে যাবে। সত্যি সত্যিই বনের মধ্যে দেখার অনেক জিনিস রয়েছে। সেই সব দেখে যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়বে তখন সে তাকে ভলার ধারে নিয়ে যাবে। যদিও সে লম্বা নয় তবুও যে সে শক্তিমান একথা সে জানে। লাল বেরির হার গড়িয়ে দেবে সে। আজ রাজকুমারী তার পোশাকের ওপরে যে সাদা বেরির। হার পরেছিল তারই মতো সুন্দর দেখাবে লাল বেরি। সে সবও যখন রাজকুমারীর আর ভালো লাগবে না তখন সে তার জন্যে অন্য ব্যবস্থা করবে।
কিন্তু রাজকুমারী বর্তমানে কোথায়? সাদা গোলাপকে জিজ্ঞাসা করল। সে কিন্তু কোনো উত্তর পেল না। সারা প্রাসাদটাই যেন ঘুমোচ্ছে। এমন কি যে সব জানালা খোলা ছিল তাদের। ওপরেও ঝুলছিল বেশ মোটা পর্দা। ভেতরে ঢোকার একটা কিছু রাস্তা বার করার জন্যে সে প্রাসাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। অবশেষে সে দেখতে পাল ছোটো একটা খিড়কির দরজা খোলা রয়েছে। ঢুকতেই সে চমৎকার বেশ বড়ো একটা ঘরের ভেতরে হাজির হল। তার ভয় হল ঘরটা বনের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। কারণ দেওয়ালে তার নকশা-কাটা; আর মেঝেটাও রঙিন পাথর দিয়ে মাডা একরকম ভ্যামিতিক পদ্ধতিতে সেগুলি গাঁথা। কিন্তু খুদে রাজকুমারী সেখানে নেই। রয়েছে কেবল উঁচু বেদীর ওপরে কয়েকটি মূর্তি বিষণ্ণ উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে আর অদ্ভুত রকমের হাসি হেসে তারা তার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
ওই ঘরেরই শেষ প্রান্তে আর একখানা ঘর নকশা করা কালো ভেলভেটের পর্দা ঝুলছে সেখানে। রাজকুমারী কি ওরই পেছনে লুকিয়ে রয়েছে? অন্তত চেষ্টা করে দেখতে দোষটা কী? এই বলে সে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। পর্দাটাকে টেনে সরিয়ে দিল একপাশে। না, ওখানে কেউ নেই। রয়েছে একখানা ঘর। সেটা আগের ঘরের চেয়েও সুন্দর। আগে এই ঘরটা ব্যবহার। করতেন জাঁলিফো। সবাই তাঁকে পাগলা রাজা বলে ডাকতা শিকার করতে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে ঘুমোতে-ঘুমোতেও তিনি চিৎকার করে উঠতেন। এখন এটা মন্ত্রণাকক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
অবাক চোখে আমাদের খুদে বামনটি চারপাশে তাকাতে লাগল। আর এগোতে তার সাহস হল না। কিন্তু সেই সুন্দরী রাজকুমারীর কথা ভেবে তার বুকে বল এল। সে তো কেবল তাকেই চায়। সে যে তাকে কত ভালোবাসে সেই কথাটাই তো সে তাকে জানাতে চায়। সম্ভবত রাজকুমারী তার পাশের ঘরেই রয়েছে।
সেই নরম মোটা কার্পেট পেরিয়ে সে ছুটে গেল সামনে; দরজা খুলল, না! সেখানেও সে নেই। ঘর খালি। সেখানে রয়েছে কেবল একটা সিংহাসন। এখানে আগে রাজা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অভ্যর্থনা জানাতেন। এখন আর বেশি রাষ্ট্রদূত আসে না। তাই রাজা এখানে পরিচিতদের দর্শন দেন। ইংলন্ডের রানির সঙ্গে স্পেনের যুবরাজের বিয়ের সম্বন্ধ করতে এই ঘরেই অনেক বছর আগে একদন ইংলন্ড থেকে দূত এসেছিল। নানা ঐশ্বর্য আর রম্য স্মৃতির চিহ্ন দিয়ে এই ঘরটি সাজানো। কিন্তু খুদে বামনটির এসব দিকে বিশেষ লক্ষ বা আকর্ষণ ছিল না। সে চেয়েছিল তাঁবুতে রাজকুমারী যাওয়ার আগে তার সঙ্গে একবার দেখা করতে এবং নাচের। শেষে তার সঙ্গে বনে চলে যাওয়ার কথা বলতে। প্রাসাদে বাতাস বড়ো ভারী; কিন্তু অরণ্যে হওয়া মুক্তা প্রভাতের সোনালি রোদ সারা বনের ওপরে সোনার রঙে রাঙিয়ে দেয়। নিশ্চয়। তার সঙ্গে দেখা হলে সে তাকে নিয়ে যাবেই। এই ভেবেই তার মুখের ওপরে হাসি ফুটে উঠল। পরের ঘরে সে ঢুকে গেল।