দৈত্যের মতো তাকে বাগানে ঘুরে বেড়াতে দেখে ফুলেরা ভীষণ বিরক্ত হল।
টিউলিপ ফুলেরা বলল–লোকটা এতই কুৎসিত যে আমরা যেখানে থাকি সেখানে ওকে খেলা করতে দেওয়া উচিত নয়।
লাল টকটকে লিলিরা তো চটে লাল, তারা বেশ উষ্মার সঙ্গে বলল–আফিঙের জল খেয়ে লোকটার হাজার বছর ঘুমানো উচিত।
কান্নার সুরে ক্যাকটাস বলল–লোকটা একেবারে মূর্তিমান আতঙ্ক–যাকে বলে একেবারে অষ্টবক্র। আর ওর মাথাটা কী বিরাট দেখেছ? ও দে পায়ের ওপরে অত বড়ো মাথাট কী বেখাপ্পাই না দেখাচ্ছে! ওকে দেখেই আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ও যদি আমার কাছে আসে তাহলে ও গায়ে আমার কাঁটা দিয়ে এমন ফুটিয়ে দেব না!
সাদা গোলাপ-গাছটা বলল–সত্যি বলতে কি ও আমার সেরা ফুলটা নিয়ে নিয়েছে। আজ সকালে রাজকুমারীকে আমি ওটা নিজেই দিয়েছিলাম তাঁর জন্মদিনের উপহার হিসাবে ও তাঁর কাছ থেকে ফুলটা চুরি করে নিয়েছে। এই বলেই সে চিৎকার করে উঠল–চোর!চোর!
চরিত্রের দিক থেকে লাল জিরেনিয়াম ফুলগুলি সাধারণত বেশ নম্র। ফুলের জগতে তার অনেক দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তারাও তাকে দেখে বিরক্তিতে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল। ভাযলেট চুলেরা বেশ নম্রভাবেই মন্তব্য করল: লোকটা খুবই সাদাসিধে মলে, সাদাসিধে না হয়ে ও পারে না। তবু তারা বেশ বিজ্ঞভাবেই বলল যে ওটাই ওর সত্যিকারের ত্রুটি; এবং রোগটাকে সারানো যায় না বলে মানুষকে প্রশংসা কেন করা হবে সে বিষয়ে তারা বেশ। যুৎসই একটা যুক্তি খুঁজে পেল না। এমন কি তারা একথা বলতেও দ্বিধা করল না যে ওই খুদে। বামনটা তার কুৎসিত রূপটাকে নিয়ে বড়ো বেশিই বাড়াবাড়ি করছে, তার উচিত ছিল কিছুটা দুঃখ করা; অন্তত কিছুটা বিষণ্ণ হওয়া। তা না করে হতভাগাটা বিপুল আনন্দে লাফালাফি দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।
ওদের মধ্যে সূর্য-ঘড়িটাই বোধ হয় সবচেয়ে বিশিষ্ট বস্তু। সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এর মতো মানুষকেও সে সময় বলে দিতে পেরেছিল। ওই খুদে বামনের চেহারা তাকেও কেমন যেন ঘাবড়ে দিয়েছিল। ফলে ছায়ার আঙুল দিয়ে পুরো দুটি মিনিট সময় নির্ধারণ করতে সে ভুলে গিয়েছিল। রেলিঙের ধারে দুধের মতো সাদা যে ময়ূরটা রোদ পোহাচ্ছিল তাকে লক্ষ করে। তাই সে না বলে পারল না–সবাই ডালে রাজার ছেলে রাজাই; আর কয়লা কুড়ানির ছেলে কয়লা কুড়ানিই। এর ব্যাতিক্রম কিছু রয়েছে এটা চিন্তা করাই হাস্যকর। এই মন্তব্যের সঙ্গে ময়ূরও একমত, তাই সে চিৎকার করে বলল–নিশ্চয়, নিশ্চয়। তার সেই কাংস ক্রেংকার ধ্বনি। শুনে ঠান্ডা ঝরনার জলে যে সমস্ত সোনালি মা-এর দল জলকেলি করছিল তারা হঠাৎ ভ্য পেয়ে চমকে উঠে জলের ওপরে মাথা তুলে বিরাট বিরাট পাথরের মূর্তিগুলিকে জিজ্ঞাসা করল–পৃথিবীকে কী ঘটছে বল তো? এত হইচই কেন?
যাই হোক, পাখিরা কিন্তু তাকে বেশ পছন্দ করত। বনের ঝরা পাতার পেছনে-পেছনে বনপরীরদের মতো ছুটতে তারা তাকে দেখেছে অথবা প্রাচীন ওক গাছের কোটরে যুঁড়ি দিয়ে শুয়ে কাঠবিড়ালির সঙ্গে ভাগ করে সে বাদাম খাচ্ছে এ-দৃশ্যও অনেকবার তাদের চোখে পড়েছে। ও যে একটু কুৎসিত তার জন্যে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। এমন কি অমন যে নাইটিংগেল পাখি যার মিষ্টি গান শোনার জন্যে মাঝে-মাঝে কমলালেবুর ঝোপের মধ্যে চাঁদও ঝুঁকে পড়ে, সেই বা কী এমন আহামরি দেখতে! তা ছাড়া, মনটাও ওর বড়ো উদার। কড়া শীতের দিনগুলিতে যখন বনের মধ্যে বেরি ফল দুপ্রাপ্য হয়ে ওঠে, মাটি লোহার মতো শক্ত বরফে ভরে যায়, এমন কি খাবারের সন্ধানে বুলো ভালুকগুলো পর্যন্ত শহরের দরজায়। এসে উপস্থিত হয়–সেই সময়েও ও একবারও তাদের কথা ভোলেনি; নিজের সামান্য খাবার তাদের ভাগ করে দিয়েছে।
সেই জন্যে তারা তার চারপাশে ঘুরে-ঘুরে উড়তে লাগল; ওড়ার সময় তাদের পাখা দিয়ে তার গলাটা সপর্শ করে গেল। এই দেখে বামন খুব খুশি। সে তাদের সেই সাদা গোলাপটা দেখিয়ে বলতে লাগল–দেখ, দেখ। এটা আমাকে রাজকুমারী উপহার দিয়েছে। কারণ, রাজকুমারী তাকে ভালোবাসে।
তার কথার বিন্দুবিসর্গ তারা বুঝতে পারল না, কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না। তারা ঘাড়গুলিকে একদিকে ঘুরিয়ে বিজ্ঞের মতো বসে রইল। কোনো কিছু বোঝার ওইটাই একমাত্র প্রশস্ততম আর সহজতম পথ
এমন কি টিকটিকিগুলিও তাকে বেশ পছন্দ করত। কারণ ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সে যখন ঘাসের ওপরে গড়াগড়ি দিত তখন তারা তার গায়ের ওপরে লাফালাফি করত। তারা বলাবলি করত–অবশ্য টিকটিকির মতো সুন্দর প্রাণী সবাই হতে পারে না–সেকথা চিন্তা করাও বাতুলতা। আর যদিও বলতে বেশ অদ্ভুত-ই লাগছে তবু একথা সত্যি যে লোকে ওকে যতটা কুৎসিত মনে করে ও ততটা কুৎসিত নয়। শুধু চোখ দুটো তোমার বন্ধ করে রাখ ওর দিকে তাকিয়ো না। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চরিত্রের দিক থেকে টিকটিকিরা। প্রথম শ্রেণির দার্শনিক। যখন করার কিছু না থাকে, অথবা বৃষ্টির দিনে যখন বাইরে বেরোনো। যায় না তখন তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চুপচাপ বসে থেকে চিন্তা করে যায়।
ওদের চালচলন আর ব্যবহারে ফুলেরা বড়োই বিষুব্ধ হয়ে উঠল। নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করতে লাগল-রাতদিন এই রকম ফল-ফস করে, হইচই করে উড়ে বেড়ানোর ফলটা কী বিষময় দেখ। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা আমাদের মতো চিরকাল একই জায়গায় বসে থাকে। লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে অথবা ফড়িং-এর পেছনে ঘাসের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বেড়াতে কেউ কি আমাদের কখনো দেখেছে? হাওয়া পরিবর্তনের প্রয়োডন বুঝলে আমরা বাগানের মালিকে সংবাদ পাঠাই। সে অন্য বিছানায় আমাদের বয়ে নিয়ে যায়। আমরা যে সম্ভ্রান্ত শ্রেণির এটা থেকেই তা প্রমাণিত হয় এবং তাই হওয়া উচিত। কিন্তু পাখপহষ্কী আর টিকটিকি-গিরগিটিদের বিশ্রাম করার যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সে বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই। আর সত্যি কথা বলতে কি পাখিদের স্থায়ী কোনো ঘরবাড়িও নেই। তারা জিপসিদের মতোই ভবঘুরে। তাদের ঠিক সেই ভাবেই দেখা উচিত।