এগিয়ে এল একদল সুন্দর চেহারার ইজিপশিয়ান–যাযাবরদের তখন সবাই ইজিপশিয়ান বলেই চিহ্নিত করত। গোল হয়ে পায়ের উপরে পা তুলে দিয়ে বসে তারা তাদের তারের যন্ত্র তুলে নিল। খাদের সুর উঠল; আর সেই সুরের তালে-তালে দেহগুলিও তাদের দুলতে লাগল। ডন পেড্রোকে দেখেই তারা ভেংচি কাটল; আবার কেউ কেউ ভীষণ ভয় পেয়ে গেল; কারণ কয়েকদিন আগেই এই পেড্রো ডাকিনীবিদ্যার অজুহাতে ওদের দুজনকে খোলা বাজারে ফাঁসি দিয়েছিল। কিন্তু ফুটফুটে রাজকুমারী তার পাখার ওপরে ঝুঁকে যখন তার নীল চোখ দুটি দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল তখন তারা বেশ খুশিই হল; কারণ তারা বুঝেছিল নিষ্পাপ সুন্দর মুখ কারও ওপরে কোনোদিন নির্দয় হতে পারে না। তারপরেই হঠাৎ তারা এমনভাবে চিৎকার করে উঠল যে শিশুরা তো ঘাবড়ে গেল, এমনকি ডন পেড্রো পর্যন্ত চমকে উঠে তার কোমরের ছোরাটাকে শক্ত করে ধরলো। সেই গায়করা তখন উন্মত্তের মতো মাঠের মধ্যে নাচানাচি আর জোরাল সুরের তালে-তালে তাদের মাতৃভাষায় বিকৃত সুরে প্রেমের গান গাইতে লাগল। তারপরেই তারা সবাই মাটির ওপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল; মনে হল তারা সব মরে গিয়েছে। মৃদু বাজনার তালে-তালে তাদের দেহের মৃদু স্পন্দনগুলি কেবল দেখা গেল। তারপরে তারা সবাই দল বেঁধে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই কটা রঙের লোমশ একটা ভালুককে চেন দিয়ে বেঁধে তারা টানতে-টানতে নিয়ে এল। তার কাঁধের উপরে কয়েকটা ‘বারবারি’ বাঁদর, পরিপূর্ণ গাম্ভীর্যের সঙ্গে ভালুকটা মাথার ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াল; আর বাঁদরগুলি তাদের মনিব দুটি জিপসি ছেলের সঙ্গে নানারকম খেলা দেখাতে লাগল। ছোটো ছোটো তরোয়াল নিয়ে তারা খেলা করল, বন্দুক ছুঁড়ল, আর রাজার সত্যিকার সৈন্যবাহিনীর মতো রীতিমতো কুচকাওয়াজ করল। এক কথায় জিপসিদের খেলা সত্যই বড়ো মনোরম হয়েছিল।
কিন্তু প্রভাতকালীন সমস্ত খেলার মধ্যে বাচ্চা বামনের নাচটাই বোধ হয় সেরা হয়েছিল। বামনটা যখন তার বাঁকানো পা দুটোর ওপরে ভর দিয়ে আর তার বিরাট বিকৃত মাথাটাকে এপাশে-ওপাশে দোলাতে-দোলাতে খেলার মাঠে নামল তখন বাচ্চারা হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল; আর খুদে রাজকুমারীও এত হাসতে শুরু করল যে শেষ পর্যন্ত ক্যামেরারাকে বলতে বাধ্য হতে হল যে সমগ্রোত্রীদের কাছে রাজকুমারীর কান্নার নজির স্পেনের ইতিহাসে থাকলেও, যারা নিচুস্তরের মানুষ তাদের কাছে সত্যিকার রাজকুমারীর হাসির নজির আজ পর্যন্ত নেই। কিন্তু বামনের খেলার সত্যিকার কোনো জবাব নেই। এমন কি যে সপ্যানিশ রাজদরবারে সব সময়েই পরিশীলিত বীভৎসতার জন্যে প্রসিদ্ধ ছিল সেখানেও এই জাতীয় অদ্ভুত খুদে দৈত্যকে আর কোনোদিন দেখা যায়নি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে এইটাই তার প্রথম খেলা। মাত্র একদিন আগে একে আবিষ্কার করা হয়েছিল। তখন সে বনের মধ্যে বিপুল বেগে ছুটে বেড়াচ্ছিল। স্পেনের দুজন নোবল শিকারের জমকালো পোশাক পরে সেই বনে গিয়েছিল শিকার করতে। রাজকুমারীকে অবাক করে দেওয়ার জন্যে তারাই তাকে ধরে এলেছিল। তার দরিদ্র বাবাও এইকম অপদার্থ কুৎসিত ছেলেকে বিদায় করে বেঁচেছিল। বোধহয় সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে তার এই অদ্ভুত বিকলাঙ্গের কথা সে নিজেও জানত না। সত্যি কথা বলতে কি এই খেলা দেখিয়ে সে নিজেও বেশ আনন্দ পেযেছিল। শিশুরা যখন হাসছিল, সেও তখন তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসছিল। প্রতিটি খেলার শেষে সে তাদের দিকে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল। মনে হয়েছিল সে যেন ওদেরই একজন; প্রকৃতি যে অপরকে হাসানোর জন্যে খামখেয়ালির বশে তাকে বিকৃতাঙ্গ করে সৃষ্টি করেছিল সেকথা সে ভাবতেও পারেনি। আর রাজকুমারী তো একেবারে মোহিত হয়ে গিয়েছিল। সেও রাজকুমারীর দিক থেকে তার চোখ দুটো সরাতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল কেবল রাজকুমারীর জন্যেই সে নাচবে। রাজকুমারীও শেষকালে কিছুটা রসিকতা আর কিছুটা ক্যামেরারাকে বিরক্ত করার জন্যে তার চুল থেকে একটা গোলাপ খুলে মিষ্টি হেসে তার দিকে ছুঁড়ে দিল। বামনও সব জিনিসটা বেশ আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করল। গোলাপ ফুলটাকে বিকৃত ঠোঁটের উপরে চেপে একটা হাত সে নিজের বুকের ওপরে রাখল। আনন্দে তার মুখের ওপরে বিকৃত হাসি ফুটে উঠল। চোখ দুটো চকচক করতে লাগল তার।
বামন খেলা শেষ করে ছুটে বেরিয়ে গেল মাঠ থেকে। রাজকুমারী মুষড়ে পড়ে তার কাকাকে বলল–এখনই আবার ওকে খেলা দেখাতে বলুন। কিন্তু ক্যামেরারা তাকে বুঝিয়ে বলল যে, অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। এখন রাজকুমারীর প্রাসাদে ফেরা উচিত। সেখানে তার জন্মদিন মহা সমারোহে উদযাপন করার জন্যে বিরাট ভোজের আয়োজন হয়েছে, তার নিজের হাতে সই করা সত্যিকার জন্মদিনের কেক তৈরি করা হয়েছে। এই সব শুনে রাজকুমারী পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে উঠে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেল; কিন্তু যাওয়ার আগে নির্দেশ দিয়ে গেল যে মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতির পরে আবার সেই বামনকে খেলা দেখাতে হবে। যাওয়ার আগে টিমেরা-নেভার কাউন্টকেও তার অপূর্ব অভ্যর্থনার জন্যে সে ধন্যবাদ জানাল। তার পিছুপিছু ছেলেমেয়েরাও ফিরে গেল–ঠিক যেভাবে তারা পরপর এসেছিল ঠিক সেইভাবেই ফিরল তারা।
খুদে বামন যখন শুনল রাজকুমারীর বিশেষ ইচ্ছাতেই আবার তাকে তার কাছে নাচতে হবে তখন সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। দৌড়ে বাগানের মধ্যে বেরিয়ে গেল সে। সেইখানে সেই সাদা গোলাপটা নিয়ে হাস্যকর একটা আনন্দে চুমু খেতে লাগল। তার আনন্দ বাইরে প্রকাশ করতে লাগল একটা বিকৃত অঙ্গভঙ্গির ভেতর দিয়ে।