রাজকুমারী একটু মনোক্ষুণ্ণ হল। বিরক্তিতে কাঁধটা কোঁচকাল! আজ তার জন্মদিন। এদিনটা তিনি এখানে থাকতে পারতেন। নিরর্থক সরকারি কাজগুলির দাম তাঁর কাছে এতই বেশি? অথবা যে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিমর্ষ ঘরটিতে সব সময়েই বাতি জ্বলছে, আর যে ঘরে তাকে যেতে দেওয়া হয় না সেইখানেই তিনি গিয়েছেন। কী বোকা, কী বোকা! এই উজ্জ্বল আলো ছেড়ে, এই আনন্দ ছেড়ে কেউ আবার সেই অন্ধকার ঘরে যায়! তা ছাড়া শিঙা বাজছে। এখনই ষাঁড়ের লড়াই শুরু হবে। এদিক থেকে তার কাকা আর গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর অনেক বেশি বিজ্ঞ। তাঁরা অলিন্দের ওপরে এসে তাকে উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং সুন্দর মাথায় ঝাঁকানি দিতে দিতে ডন পেড্রোর হাত ধরে সে লম্বা তাঁবুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। বাগানের শেষ প্রান্তে লাল সিল্ক দিয়ে তৈরি এই তাঁবু। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরাও তাদের পিছু পিছু এগিয়ে গেল। যার নাম সবচেয়ে লম্বা সেই চলল তাদের আগে। নামের দৈর্ঘ্যর মাপে নিজেদের শ্রেণিকে সাজিয়ে নিল তারা।
অভিজাত সম্প্রদায়ের একদল ছেলে তার সঙ্গে দেখা করল। তাদের ভেতরে ছিল তিয়েরা-নেভার যুবক কাউন্ট। বয়স তার চোদ্দর কাছাকাছি। অভিজাত সম্প্রদায়ের লাবণ্য আর পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে এসে সে রাজকুমারীকে অভ্যর্থনা জানাল; তারপরে মাঠে যেখানে হাতির দাঁতের উঁচু চেয়ার বসানো রয়েছে সেইখানে তাকে নিয়ে গেল।
ষাঁড়ের লড়াই যা হল তা সত্যিই অপরূপ! রাজকুমারীর মনে হল পার্মার ডিউক তার বাবার সঙ্গে যখন দেখা করতে এসেছিলেন তখন যে সত্যিকার ষাঁড়ের লড়াই সে দেখেছিল এ লড়াই তার চেয়েও সুন্দর। কয়েকটি বালক বেশ ভালোভাবে সাজানো খেলার ঘোড়ার চারপাশে লম্বা বর্শা নিয়ে ঘোড়ার মতো পা তুলে-তুলে লাফাতে লাগল। আর কয়েকজন পায়ে হেঁটে তাদের লাল আলখাল্লা ষাঁড়ের সামনে দোলাতে শুরু করল। আর সেই ষাঁড় যখন তেড়ে এল তখন তারা বেড়ার এপাশে লাফিয়ে পালিয়ে এল। আর ষাঁড়টাকে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন সত্যিকারের একটা ষাঁড়। আসলে সেটা কিন্তু চাঁচ, দরমা, আর কঞ্চি দিয়ে তৈরি ছিল; তার ওপরে চাপা দেওয়া ছিল লম্বা একটা চামড়া। মাঝে-মাঝে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে বেড়ানোর তাল কষছিল। এভাবে ছোটার কথা সত্যিকার কোনো জীবন্ত ষাঁড় স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। আর যুদ্ধও সে কম করল না। ছেলেরা সব গাছের ডালে লাল শালু ওড়াতে-ওড়াতে ব্র্যাভো ব্র্যাভো বলে চেঁচাতে লাগল। মনে হল তারা যেন সত্যিকার বয়স্ক মানুষ। বহুক্ষণ ধরে যুদ্ধ চলল। এরই মধ্যে অনেকগুলি খেলার ঘোড়া শিংয়ের গুঁতো খেয়ে ধরাশায়ী হয়েছে। শেষকালে বিষম রণের পরে তিয়েরা-নেভার কাউন্ট সেই ষাঁড়টাকে হাঁটু মুড়ে বসাল, তারপরে রাজকুমারীর কাছ থেকে চরম আঘাত হানার নির্দেশ পেয়ে সে তার কাঠের তরোয়ালটা ষাঁড়ের ঘাড়ে এমন জোরে ঢুকিয়ে দিল যে ষাঁড়ের মাথাটা আলাদা হয়ে গেল; আর তার ভেতর থেকে হাসতে-হাসতে বেরিয়ে এল মাদ্রিদের ফরাসি রাষ্ট্রদূতের পুত্র মঁসিয়ে দ্য লোরেঁ।
যুদ্ধক্ষেত্র পরিস্কার করার পালা এবার। জমকালো হলদে আর কালো পোশাক পরা দুজন মুরদেশীয় চাকর সেই খেলার মৃত ঘোড়াগুলির দেহ বেশ গম্ভীরভাবে বয়ে নিয়ে গেল বাইরে। তারপরে একটু বিরতি। এরই মধ্যে ফরাসি যাদুকর দড়ির ওপরে হেঁটে বেড়ালো; ইতালির মুখোশ অভিনীত হল। তারা এত সুন্দর আর স্বাভাবিকভাবে অভিনয় করল যে, পালার শেষ রাজকুমারীর চোখ দুটো জলে ভর্তি হয়ে গেল। এমন কি কয়েকটা ছেলেও দুঃখে আর্তনাদ করে উঠলো; তাদের কান্না থামানোর জন্যে শেষ পর্যন্ত তাদের মেঠাই খেতে দিতে হল। আর গ্র্যান্ড ইনকুইডিটর-ও এত অভিভূত হয়ে পড়লেন যে শেষ পর্যন্ত ডন পেড্রোকে তিনি বলতে বাধ্য হলেন–এই সব অভিনেতারা যদিও কাঠ আর রঙিন মোম দিয়ে তৈরি হয়েছে, আর যন্ত্রের সাহায্যে এদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করছে তবু এরা যে এত স্বাভাবিকভাবে এদের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করছে এ দেখে সত্যিই তিনি মর্মাহত হয়েছেন।
তারপর এল আফ্রিকান যাদুকর। সঙ্গে নিয়ে এল একটা চ্যাপ্টা ঝুড়ি। লাল কাপড় দিয়ে সেটা ঢাকা। বাক্সটাকে জমির মাঝখানে রেখে পাগড়ির ভেতর থেকে অদ্ভুত একটা শরের পাইপ বার করে বাজাতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কাপড়টা সরতে শুরু করল, বাঁশির সুরটা জোরাল হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দুটো সবুজ আর সোনালি রঙের সাপ তাদের গোঁজের মতো মাথাগুলি বার করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল; তারপরে বাঁশির তালে-তালে জলের মধ্যে লতার মতো এদিকে-ওদিকে দুলতে লাগল। তাদের সেই চিত্রিত ফণা আর লকলকে জিব দেখে শিশুরা বেশ ভয় পেযে গেল। কিন্তু তারপরেই যাদুকর যখন বালির ভেতর থেকে ফুটফুটে একটা কমলালেবুর গাছ তৈরি করে তাতে ফুল ফোঁটাল আর ফল ধরাল তখন তারা বেশ খুশি হয়ে উঠল। তারপরে যাদুকর মার্কুই দ্য লা টোরে-র বাচ্চা মেয়ের পাখাটা নিয়ে তা থেকে একটা নীল পাখি তৈরি করে ফেলল। সেই পাখিটা তাঁবুর চারপাশে ঘুরে-ঘুরে গান গাইতে লাগল। তাই দেখে শিশুদের আনন্দ আর ধরে না। নুয়েস্ত্রা সেনোরা দল পিলারের গির্জা থেকে কতগুলি নাচিয়ে বালক এসেছিল। তাদের দ্বৈত নাচ বড়োই সুন্দর হয়েছিল। এই নাচ প্রতি বছর মে মাসে ভার্জিনের বেদীর কাছে দেখানো হয়, কিন্তু রাজকুমারী আগে কোনো দিনই সে-নাচ দেখেনি। একজন উন্মাদ পাদরি, অনেকের মতে ইংলন্ডের রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে, একবার অ্যাসটুরিয়াস-এর যুবরাজকে খাম জোড়ার সঙ্গে বিষাক্ত গঁদ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেই থেকে স্পেনের রাজবংশের কেউ স্যারাগোসার বিরাট গির্জায় ঢোকেনি। এই নাচের নাম ছিল ‘আওয়ার লেডিস ড্যান্স’। রাজকুমারী লোকমুখে ওই নামটাই কেবল শুনেছিল। এই নাচ সত্যিই বড়ো সুন্দর দেখতে। এই নাচ দেখে রাজকুমারী এতই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল যে প্রতিদানে আওয়ার লেডি অফ পিলারের কাছে বেশ বড়ো একটা মোমের বাতি পাঠাতে কৃতসংকল্প হয়েছিল।