সারাটা দিনই যেমন রোদ উঠেছিল তেমনি ছিল গরম, শীতল। সন্ধ্যায় সবাই মোটরে চড়ে বেড়াত গেযেছিল। রাত্রি ন’টার আগে কেউ ফেরেনি সেদিন। ফিরেই সামান্য আহার করেছিল সবাই। সেদিন ভূত নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সুতরাং ভূতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা করার প্রাথমিক কোনো শর্তও সেদিন ছিল না। মিঃ ওটিসের কাছে আমি শুনেছিলাম সেদিন তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন ধরনের, বিশেষ করে অবস্থাপন্ন আমেরিকানরা যে সব বিষয় নিয়ে সাধারণত আলোচনা করে–যেমন, অভিনেত্রী হিসাবে সারা বার্নদোতের চেয়ে মিস ফ্যানি ড্যাভোনপোর্টের শ্রেষ্ঠতা, এমন কি অবস্থাপন্ন ইংরাডংদের বাড়িতে সবুজ শস্য, বাকযুইট কেক, দুধে সেদ্ধ ভুট্টাচূর্ণের দুষ্প্রাপ্যতা; পৃথিবীর আত্মাকে বাঁচানোর জন্যে বোস্টন বন্দরের প্রয়োজনীয়তা, রেল-ভ্রমণে গাঁটরি পরীক্ষা করার সুবিধা, লন্ডনের বিরক্তিকর উচ্চারণের তুলনায় নিউ ইয়র্কের উচ্চারণের মিষ্টতা ইত্যাদি। অতিপ্রাকৃত ঘটনার সম্বন্ধে। কোনো আলোচনাই সেদিন হয়নি, এমন কি গল্পচ্ছলে স্যার সাইমন দ্য ক্যাটারভাইলের নাম উচ্চারণও কেউ করেননি। রাত্রি এগারোটার সময় সবাই শুয়ে পড়লেন এবং সাড়ে এগারোটার মধ্যেই ঘরের আলো সব নিবে গেল। কিছুক্ষণ পরে ঘরের বাইরে বারান্দায় ওপরে একটা অদ্ভুত শব্দে মিঃ ওটিসের ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা শুনে মনে হল ধাতুত ধাতুতে ঠোকাঠুকির শব্দ। আরো মনে হল শব্দটা ক্রমশ তাঁর ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি। বিছানা থেকে উঠে দেশলাই জ্বালিয়ে সময়টা দেখে নিলেন। ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় একটা বেড়েছে। বেশ শান্তভাবেই নিজের নাড়িটা দেখে নিলেন। না; এতটুকু বেচাল হয়নি নাড়ি। সেই অদ্ভুত শব্দটা তখনো হচ্ছিল। তিনি বেশ স্পষ্টই শুনতে পেলেন কেউ যেন পা ঠুকে ঠকে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। চটি পরে তিনি তাঁর ‘ড্রেসিং কেস’ থেকে লম্বাটে একটা ফাইল। বার করে দরজাটা খুললেন। ম্লান চাঁদের আলোতে তিনি দেখলেন তাঁরই সামলে ভয়ঙ্কর চেহারার এরটি বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখ দুটো জলন্ত কয়লার মতো জ্বলছে। জটার মতো লম্বা ধূসর চুলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার কাঁধের ওপরে। তার পরিধানে প্রাচীন কালের পোশাক, সেগুলি যেমন নোংরা, তেমনি ফেঁড়া। তার হাতের কব্ধি আর পায়ের গাঁট থেকে বেশ ভারী আর মরচে-পড়া শেকল ঝুলছে।
মিঃ ওটিস বললেন–প্রিয় মহাশয়, ওই শেকলগুলিতে তেল দেওয়ার জন্য বাধ্য হয়েই আমি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি। আর সেই জন্যেই তামানি রাইসিং সান লিউব্রিকেটর’-এর একটা ছোটো শিশি আমি এনেছি। একবার লাগালেই কাজ হবে এতে। এর গুণ কত সে সম্বন্ধে। প্রশংসাপত্র-ও এর গায়ে সাঁটা রয়েছে। শোওয়ার ঘরের বাতির কাছে এটা আমি রাখছি। প্রয়োজন হলে এই জাতীয় আরো তেল আমি আপনাকে আনন্দের সঙ্গেই সরবরাহ করব।
এই বলে যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী মহোদয় মার্বেল টেবিলের ওপরে শিশিটি রেখে দরজা বন্ধ করে শোওয়ার জন্যে প্রস্থান করলেন।
স্বাভাবিক একটা ঘৃণা আর বিরক্তিতে ক্যানটারভাইলের ভূত এক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপরে সেই পালিশকরা মেঝের ওপরে সজোরে শিশিটাকে আছাড় দিয়ে শুকনো আর্তনাদ করতে করতে আর ভৌতিক সবুজ একটা আলো ছড়াতে ছড়াতে ভূতটি বারান্দা। দিয়ে পালিয়ে গেল। ঠিক যখন সে ওক কাঠের বিরাট সিড়িঁটার ওপরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এমন সময় একটা দরজা হাট হয়ে খুলে গেল; দুটি খুদে সাদা পোশাক-পরা মূর্তির আবির্ভাব হল। আর সেই সঙ্গে একটা লম্বা বলিশ তার মাথার ওপর দিয়ে হুইশ-ইশশব্দে করে উড়ে গেল। নষ্ট করার মতো সময় আর না থাকায় ভূতটি ঝটিতি চতুর্থ ডাইমেনশনের সাহায্যে কাঠের তক্তার ভিতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপরে শান্ত ই বাড়িটি।
বাড়িটা বাঁ দিকে ছোটো একটা গোপন কষ্কে ঢুকে চাঁদের রশ্মির পিঠে হেলান দিয়ে বসে সহজভাবে সে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। সেইখানে বসেই নিজের অবস্থাটা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করল সে। বিগত তিনশো বছরের গৌরবোজ্জ্বল এবং নিবরচ্ছিন্ন জীবনে এইভাবে অপমানিত সে আর কোনোদিন হয়নি। বিধবা ডাচেসের কথা তার মনে পড়ল। লেস আর মুক্তা হাতে নিয়ে যখন তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই সময় ভয় দেখিযে সে তাঁকে জ্ঞান হারাতে বাধ্য করেছিল। একটা খালি ঘরের পর্দা তুলে সে স্রেফ ভেংচি কেটে যে চারটি পরিচারিকাকে উন্মাদ করে তুলেছিল তাদের কথা মনে হল তারা মনে হল স্থানীয় গির্জার রেকটরের কথা। একদিন বেশি রাত্রি করে লাইব্রেরি থেকে তিনি যখন ফিরছিলেন। এমন সময় সে তাঁর বাতিটা নিবিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে ভদ্রলোক স্যার উইলিয়ম। গাল-এর চিকিৎসাধীন ছিলেন। বলতে গেলে স্নায়ু-বৈকল্যেই তিনি শেষ পর্যন্ত আপ্পাদান। করেন। মনে পড়ে গেল বৃদ্ধা মাদাম দ্য ট্রিমোলিক-এর কথা। ভদ্রমহিলা একদিন প্রত্যুষে উঠে দেখেন আগুনের ধারে একটি আরাম কেদারায় বসে একটি কংকাল তাঁর নিজের ডায়েরি পড়ছে। এর ফলে তিনি দু’সপ্তাহ মানসিক রোগে বিছানায় পড়ে ছিলেন। সেরে উঠে তিনি গির্জার চলে গেলেন। তারপর থেকে কুখ্যাত নাস্তিক মঁসিয়ে দ্য ভলতেযরের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেন। সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির কথা তার মনে পড়ে গেল যেদিন গলার ভেতরে। মুক্তার মালা ঢুকিযে অসৎচরিত্র লর্ড ক্যানটারভিলেকে দমবন্ধ অবস্থায় তার ড্রেসিং রুমে পড়ে থাকতে দেখা গেল। মৃত্যুর ঠিক আগে সে স্বীকার করেছিল যে তাসের ভেলকি দেখিয়ে চার্লস জেমস ফক্সকে সে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড ঠকিযেছিল; আর ভূতই যে তাকে ওই মালাটা গিলতে বাধ্য করেছিল সেকথাও স্বীকার করতে দ্বিধা করেনি সে। সেই সব বিরাট বিরাট কৃতিত্বের কথা মনে পড়ে গেল তার মনে পড়ল বাটলারের কথা। ডানালার কপাটের ওপরে সবুজ একটা হাতকে ঠুকঠুক করতে দেখে বেচারা নিজেকেই নিজে গুলি করে হত্যা করল। সেই সুন্দরী লেডি স্টাটফিল্ডের কথাও সে ভুলতে পারল না। তাঁর সেই শ্বেতকণ্ঠের ওপরে পাঁচটা আঙুলের দাগ চিপে বসে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল সেই ক্ষত ঢাকার জন্যে তিনি সব সময় কালো ভেলভেটের বন্ধনী গলার ওপরে জড়িয়ে রাখতেন। তারপরে একদিন তিনি পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করলেন। সত্যিকার কলাবিদের আত্মম্ভরিতার উৎসাহে সে তার ভীবনের কৃতিত্বপূর্ণ অধ্যায় গুলি নিয়ে আলোচনা করল। এইসব কৃতিত্ব দেখানোর পরে কোথা থেকে হতভাগা একটা আমেরিকান এসে তাকে রাইসিং সান লিউব্রিকেটর দিতে চায়! তার। মাথা লক্ষ করে বালিশ ছুঁড়ে দেয়! অহো ভাগ্যম! অসহ্য, অসহ্য! তাছাড়া, কোনো ভুত যে। নশ্বর মানুষের কাছে এইভাবে অপমানিত হয়েছে এর নজির ভুতদের ইতিহাসে আর। কোথাও নেই। সেই জন্যে, প্রতিহিংসা চরিতার্থতাকে করতেই হবে। আর সেই চিন্তাতেই মারা দিনটাই সে মশগুল হয়ে বসে রইল।