সঙ্গীদের নিয়ে বাচ্চা রাজকুমারী অলিন্দের ওপরে লুকোচুরি খেলছে। সাধারণত নিজের পদমর্যাদার উপযুক্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই তাকে খেলা করতে দেওয়া হয়। ফলে তাকে একলাই খেলা করতে হয়। কিন্তু এই জন্মদিনটিই যা ব্যতিক্রম। রাজা নির্দেশ দিয়েছেন আজকের দিনে যার সঙ্গে খেলা করতে তার ভালো লাগে রাজাকুমারী তাকেই নিমন্ত্রণ করতে পারবে। স্পেনদেশীয় রোগাটে শিশুদের গতির মধ্যে বেশ একটা লাবণ্য রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে লাবণ্যময়ী হচ্ছে রাজকুমারী নিজে। একটু বোঝার মতো হলেও পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজ-সজ্জা তার বেশ মনোমুগ্ধকরই ছিল। ধূসর বর্ণের সাটিনের পোশাক তার গায়ে: রুপো দিয়ে মোড়া বেশ শক্ত গোছের অন্তর্বাস সে পরেছে। সরু ফিতে দিয়ে তৈরি গোলাপ ফুলের নকশা কাটা ছোটো দুটি শ্লিপার তার পায়ে। হেঁটে বেড়ানোর সময় বাইরে থেকে সে দুটিকে বেশ ভালো করেই দেখা যাচ্ছে। তার বিবর্ণ মুখের ওপরে চুলের মধ্যে জ্যোতির্মণ্ডলের মতো সুন্দর সাদা গোলাপ শোভা পাচ্ছে।
রাজপ্রাসাদের একটি বাতায়ন কক্ষে বিষণ্ণ রাজা বসে রয়েছেন। এদের সবাইকে তিনি দেখছিলেন, তাঁর পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর ভাই অ্যারাগনের ডন পেড্রো; এই ভাইটিকে তিনি ঘৃণা করতেন। তাঁর কনফেশর গ্রানাদার গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর বসেছিলেন তাঁর পাশে। অন্যান্য দিনের চেয়ে রাজা আজ বেশি বিষণ্ণ। তাঁর শিশু কন্যাটি তার শিশুসুলভ গাম্ভীর্যে সমবেত পারিষদবর্গকে মাথা নীচু করে অভিবাদন জানাচ্ছিল। সেই মেয়েকে দেখতে-দেখতে তিনি তখন তার মা যুবতী রানির কথা চিন্তা করছিলেন। তাঁর মনে হল মাত্র কিছুদিন হল ফ্রান্সের আনন্দোজ্জ্বল দেশ থেকে তিনি এখানকার রানি হয়ে এসেছিলেন। মেয়েটির জন্মের ছ’মাস পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই রানিকে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে মৃত্যুর পরে রাজা তাঁর মৃতদেহকে কবরস্থ করতে দেননি। একজন মুরদেশের চিকিৎসক তাঁর দেহটিকে ওষুধপত্র দিয়ে অবিকৃত অবস্থায় রেখে দিয়েছিল। যাদুবিদ্যার প্রয়োগের জন্যে তার প্রাণদণ্ড হয়েছিলা। কিন্তু এই কাজের জন্যে রাজা তার মৃত্যুদণ্ড মকুব করে দিয়েছিলেন। বারো বছর আগে একটি বাত্যামুখর মার্চ মাসে পাদরিরা তাঁর দেহটিকে নিয়ে প্রাসাদের একটি কালো মার্বেল গির্জায় স্থাপন করেছিলেন। কালো পোশাক পরে একটি লণ্ঠন হাতে নিয়ে রাজা প্রতি মাসে একবার করে সেখানে গিয়ে সেই দেহটির পাশে হাঁটু মুড়ে বসে আমার রানি, আমার রানি, বলে তাকে ডাকতেন। স্পেনে মানুষের প্রতিটি কাজ করার পেছনে একটা শালীন রীতি রয়েছে–এমন কি রাজার শোকেরও একটা সীমা সেখানে নির্ধারিত রয়েছে–সেই রীতি ভঙ্গ করে মৃতদেহের মণিমুক্তার গয়নাপরা বিবর্ণ হাতটা নিজের হাতে ধরে চিৎকার করে কাঁদতেন; ঠান্ডা রঙকরা গালে চুমু খেতেন উন্মাদের মতো।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে ফঁতেনব্লু দুর্গে রানিকে তিনি প্রথম দেখেছিলেন। রানির বয়স তখন আরো কম। সেদিনকার রানির মূর্তিটি আবার তাঁর চোখের ওপরে ভেসে উঠল। সেইদিন ফরাসি সম্রাটের সামনে তাঁদের বিয়ের ব্যবস্থা পাকা হয়। ফিরে আসার সময় নিয়ে এসেছিলেন পীতবর্ণ চুলের ছোটো একটি আংটি, সেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন গাড়ি থেকে নামার পরে বালিকা বধূ তাঁর হাতে যে চুম্বন করেছিলেন সেই স্মৃতি দেশের সীমান্তবর্তী ছোটো একটি নগর বার্গোতে খুব তাড়াতাড়ি তাঁদের বিয়ে হয়েছিল; তারপরে বিরাট শোভাযাত্রা করে ফিরে এসেছিলেন মাদ্রিদে। লা অ্যাটোচা গির্জায় ধর্মীয় প্রার্থনা সভা বসেছিল; এবং তারপরেই প্রায় শ’তিনেক কাফেরকে, তাদের মধ্যে ইংরাজদের সংখ্যাও অনেক ছিল, সৈন্যবাহিনির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল পুড়িয়ে মারার জন্যে।
সত্যি কথা বলতে কি রাজা তাঁকে উন্মাদের মতো ভালোবাসতেন। নতুন বিশ্বের ওপরে আধিপত্য বিস্তার করার উদ্দেশ্যে ইংলন্ডের সঙ্গে তখন তাঁর দেশের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তাঁর সেই উন্মাদ প্রেমের জন্যে তাঁর দেশের সুষ্ঠু যুদ্ধ পরিচালনাও ব্যাহত হয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্যেও তিনি তাঁকে চোখের আড়াল করতেন না। এরই ফলে অনেকের ধারণা জরুরি রাজকার্যেও তিনি অবহেলা করতেন। ভোগবাসনা মানুষকে যে ভয়ঙ্কর রকমের অন্ধ করে দেয় তারই জন্যে তিনি দেখতে পাননি যে রানিকে তুষ্ট করার জন্যে তিনি যে বিরাট আয়োজন করেছিলেন তারই ফলে রানি একটি অদ্ভুত অসুখের কবলস্থ হয়ে পড়েছিলেন। রানির মৃত্যুর পরে কিছুটা সময় তাঁর চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছিল। একবার মনে হয়েছিল সিংহাসন পরিত্যাগ করে তিনি গ্রানাদার গির্জায় গিয়ে বাকি জীবনটা পারলৌকিক চিন্তায় কাটিয়ে দেবেন; কিন্তু শিশু কন্যাটিকে তিনি তাঁর নির্দয় ভাই-এর হাতে রেখে যেতে ভয় পেলেন। কারণ, স্পেনে তাঁর ভাই-এর মতো নিষ্ঠুর আর কেউ ছিল না এবং অনেকের ধারণা রানি যখন তাঁর দুর্গ অ্যারাগনে গিয়েছিলেন তখন এই লোকটিই তাঁকে একজোড়া বিষাক্ত দস্তানা উপহার দিয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন। এর পরে রাজা রাজ্যের মধ্যে পরের তিনটি বছর শোক পালন করার নির্দেশনামা জারি করেছিলেন। তার পরেও আর একটি বিয়ে করার জন্যে কোনো মন্ত্রীই তাঁকে রাজি করাতে সক্ষম হননি। একবার সম্রাট তাঁর ভাইঝি বোহেমিয়ার সুন্দরী আর্ক ডাচেন্সের সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু বোহেমিয়ার রাষ্ট্রদূতদের ডেকে তিনি বলে দিলেন–তোমাদের সম্রাটকে জানিয়ে দিয়ো যে স্পেনের রাজা দুঃখকেই তাঁর পত্নী হিসাবে বরণ করেছেন; এবং যদিও সৌন্দর্যের তুলনায় দুঃখ অনেক বেশি বন্ধ্যা রমণী তথাপি সৌন্দর্যের চেয়ে দুঃখকেই তিনি বেশি ভালোবাসেন। তাঁর এবম্বিধ উত্তরের জন্যে অচিরাৎ তাঁকে নেদারল্যান্ড-এর প্রদেশগুলি খেসারৎ দিতে হয়েছিল; বোহেমিয়ার সম্রাটের উসকানিতে রিফর্মড চার্চের কিছু গোঁড়া নেতা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। তাঁর ছোটো মেয়েটিকে প্রাসাদের অলিন্দে খেলা করতে দেখে আগুনে উচ্ছ্বাস ভরা আর রানির হঠাৎ মৃত্যুতে যে মহাশোকের তরঙ্গ তাঁকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, বিবাহিত জীবনের সুখ-দুঃখ ভরা সেই মেয়েটির মধ্যে ফুটে বেরিয়েছে-সেই হাসি, হাসার সময় সেইভাবে ঠোঁট বাঁকানো, সেইভাবে ঘাড় নাড়ানো,–সব সব, কিন্তু শিশুদের চিৎকার তাঁর কান দুটো ব্যথিত করতে লাগল; মেঘমুক্ত নির্মল সূর্যের আলো তাঁর বেদনাকে ব্যঙ্গ করতে লাগল–এবং একটা অদ্ভুত বিশ্রী গন্ধ–শব সংরক্ষণ করার জন্যে চিকিৎসকেরা সাধারণত যে ধরনের গন্ধদ্রব্য ব্যবহার করে থাকে–সেই অস্বস্তিকর একটা গন্ধ-সত্যি? না, মতিভ্রম তাঁর?-পরিচ্ছন্ন প্রভাত-হাওয়াকে বিষাক্ত করে তুলল। হাত দুটোর মধ্যে মুখটাকে তিনি ঢেকে দিলেন। তারপরে রাজকুমারী আবার যখন মুখ তুলল তখন পর্দা পড়ে গিয়েছে–রাজা সেখান থেকে চলে গিয়েছেন।