তারপর সে ফিরে এসে যা দেখেছে সব রাজকুমারকে বলল।
রাজকুমার বলল–আমার সারা গায়ে সোনার চাদর মোডা। একটা একটা পাত খুলে নিয়ে তুমি আমার দরিদ্রদের বিলিয়ে দাও। জীবন্ত মানুষরা সব সময় মনে করে সোনার ঝালর গায়ে দিয়ে আমি খুব সুখী।
একটা একটা সোনার পাত খুলতে লাগল দোয়েল। বিশ্রী চেহারা হল রাজকুমারের। একটা একটা সোনার পাত সে দরিদ্রদের দিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রাস্তার ওপরে খেলতে শুরু করল তারা; আনন্দে চিৎকার করে বলল–আমাদের খাওয়ার সংস্থান রয়েছে।
তারপরে বরফ নামল, নামল ঘন কুয়াশা। মলে হল সব রাস্তাটাই রুপোর তাল হয়ে গিয়েছে। গলা বুপোর মতোই তারা চকচকে করে লাগল। সবাই ফারকোট গায়ে দিয়ে বেরোতে লাগল রাস্তাঘা।
বেচারা দোয়েলও দিন-দিন ঠান্ডায় কুঁকড়ে যেতে লাগল। কিন্তু রাজকুমারকে সে এতই ভালোবেসে ফেলেছিল যে কিছুতেই সে তাকে ছেড়ে যেতে পারল না। বুটিওয়ালার অসাক্ষাতে তার দরডা থেকে দু’এক টুকরো রুটি সে ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে আসত; আর ডানা নেড়ে-নেডে গরম রাখার চেষ্টা করত নিডোকো।
কিন্তু শেষকালে সে বুঝতে পেরেছিল–তার মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে। কোনরকমে আর একবার সে রাজকুমারের পিঠের ওপরে উঠে এল; বলল–প্রিয় রাজকুমার, বিদায়। তোমার হাতে একটু চুমু খেতে দেবে?
রাজকুমার বলল–আমার ছোট্ট দোয়েল তুমি যে শেষ পর্যন্ত ইভিংস্টের দিকে রওনা হতে পেরেছ তাতে আমি খুশি হয়েছি। অনেকটা বেশি সময় তোমাকে এখানে থাকতে হয়েছে।
তুমি আমার এই ঠোঁটে চুমু খাও–কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। দোয়েল বলল–আমি ইজিপ্টে যাচ্ছি নেযাচ্ছি মরণের ঘরে। মৃত্যুই তো ঘুমের ভাই। তাই না?
এবং সুখী রাজকুমারের ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে সে মারা গেল, তারপর পড়ে গেল মূর্তিটির পায়ের কাছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে মূর্তিটার ভেতরে একটা অদ্ভুত ভাঙনের শব্দ হল–মনে হল কিছু যেন একটা ভেঙেছে। আসল কথাটা হচ্ছে মূর্তির সীসের মাথাটা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। কুয়াশাটা সত্যিই ভীষণ জমাট বেঁধে গিয়েছে।
পরের দিন প্রত্যুষে টাউন কাউন্সিলরদের নিয়ে মেয়র পার্কে বেড়াচ্ছিলেন। সেই উঁচু বেদীটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি একবার মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন–হ্যায় কপাল! সুখী রাজকুমারের চেহারা এ কী হয়েছে!
কাউনসিলাররাও সব সময়েই মেয়রের সঙ্গে একমত। তারাও একবাক্যে চিৎকার করে উঠল-আরে, ছি-ছি!
মেয়র বললেন–তরোয়াল থেকে রুবিটা পড়ে গিয়েছে, চোখ দুটো নেই। সোনার পাতও দেখছি নে। মনে হচ্ছে রাজকুমার একেবারে ভিক্ষুক হয়ে গিয়েছেন।
হ্যাঁ, ঠিক একেবারে ভিক্ষুক-সায় দিল পারিষদবর্গ।
মেযর বলে গেলেন–আর এঁর পায়ের তলায় সত্যি সত্যিই একটা মরা পাখি। আমাদের এখনই একটা বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা উচিত যে এখানে আর কোনো পাখিকেই মরতে দেওয়া হবে না।
কর্পোরেশনের কেরানি কথাগুলি টুকে নিল। তারপরে তারা মূর্তিটাকে ভেঙে ফেলল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টের প্রফেসর বললেন–রাজকুমার তার মূল্য হারিয়েছে, কারণ তার আর কোনো সৌন্দর্য নেই।
তখন তারা তাকে আগুনে গলিয়ে ফেলল। ধাতুটাকে নিয়ে কী করা হবে সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওযার জন্যে মেযর একটা সভা ডাকলেন। তিনি বললেন–আমাকে অবশ্য আর একটা মূর্তি গড়তে হবে-আর সেটা হবে আমার।
সভাসদেরা বলল–আমার, আমার।
এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে তারা ঝগড়া করতে শুরু করল। শেষ খবর আমি যতটুকু পেয়েছি তা থেকে জানা যায় তারা এখন-ও ওই নিযে ঝগড়া করছে।
ধাতু গলানোর কারখানায় একজন কারিগর বলল–কী আশ্চর্য! এই ভাঙা সীসের হৃদপিণ্ডটা কিছুতেই আগুনের চুল্লিতে গলছে না।
সেই জন্যে তারা সেটাকে একটা ম্যলা ফেলার জাযগায় ফেলে দিল। সেই মরা পাখিটার দেহও পড়েছিল সেইখানে।
ঈশ্বর তাঁর দেবদূতদের বললেন–শহরের সবচেয়ে দুটি মূল্যবান জিনিস আমাকে এনে দাও। তাঁর দেবদূতেরা তাঁকে এনে দিল সেই সীসের হৃৎপিণ্ড আর মরা পাখিটার দেহ।
ঈশ্বর বললেন–তোমরা ঠিক জিনিসই এনেছ; কারণ, আমার প্যারাজাইসের বাগানে এই ছোট্ট পাখিটা অনন্তকাল ধরে গান করবে; আর আমার সোনার শহরে এই সুখী রাজকুমার আমার বন্দনা গাইবে চিরদিন।
স্পেনীয় রাজকুমারীর জন্মতিথি
রাজকুমারীর জন্মদিন। রাজকুমারীর বয়স মাত্র বারো। রাজপ্রাসাদের বাগানগুলিতে জোরাল সূর্যের আলো পড়েছে। সত্যিকারের রাজকুমারী এবং স্পেনের ইনফ্যানটা হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েদের মতোই বছরে তারও কেবল একদিনই জন্মতিথি পালিত হত। যাতে এই দিনটি বেশ সুন্দর ভাবে উদযাপিত হয়, সেই জন্যেই সারা দেশই আনন্দে মুখর হয় উঠতো। আর দিনটি সত্যিই বড়ো সুন্দর হয়ে উঠেছিল। লম্বা লম্বা সুন্দর টিউলিপ ফুলগুলি ডাঁটা ওপরে মাথা উঁচু করে ঘাসের বনে ওপাশ থেকে গোলাপের দিকে তাকিয়ে বলল–আমরাই বা কমতি কিসের? বেগুনে রঙের প্রজাপতি পাখায় স্বর্ণরেণু মিশিয়ে এ-ফুল থেকে ও-ফুলের ওপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেওয়ালের ফাটল থেকে টিকটিকিরা উঁকি দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। ডালিম ফলগুলি গরমে ফেটে পড়ায় তাদের রক্তাক্ত হৃদয়গুলি বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। চারপাশে আনন্দ আর উত্তেজনার ঢল নেমেছে। বাতাস সুগন্ধের প্রাচুর্যে উঠেছে ভারী হয়ে।