দোয়েলের হৃদয়টা ছিল সত্যিই বড়ো কোমল। তাই সে বলল–বেশ। আর একটা রাত্রি আমি তোমার জন্যে থেকে যাব। তার কাছে কি আর একটা রুবি আমি পৌঁছে দেব?
রাজকুমার বলল–হায়রে, আমার তো আর কোনো রুবি নেই। আছে কেবল এই চোখ দুটি। এই চোখ দুটি আমার দুষ্প্রাপ্য নীলকান্ত মণির। এই মণি দুটি হাজার বছর আগে ভারতবর্ষ থেকে কিনে আনা হয়েছিল। তারই একটা মণি খুলে নিয়ে তাকে দিয়ে এস। সোনার দোকালে সে সেটা বিক্রি করে জ্বালানি কাঠ কিনবে-তারপরে নাটকটা শেষ করবে সে।
দোয়েল বলল–প্রিয় রাজকুমার, ও কাজ আমি করতে পারব না। এই বলে সে কাঁদতে লাগল।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, ছোট্ট দোয়েল-আমার নির্দেশ তুমি পালন করা
সুতরাং দোয়েল রাজকুমারের চোখ থেকে একটা মণি খসিয়ে নিয়ে ছাত্রটির চিলেকোঠায় পৌঁছে দিয়ে এল। ছাদের মুখে একটা গত ছিল। তাই ঘরে ঢোকাটা খুব সহজ ছিল তার কাছে। সেই গর্তের ভেতর দিযে সে তীরবেগে ভেতরে ঢুকে গেল। যুবকটি তার দুটো হাতের মধ্যে মাথাটা চিপে বসেছিল। সেইজন্যে পাখির ডানার শব্দ তার কানে গেল না। মুখ তুলে সে দেখল শুকনো ভাবলেট ফুলের পাশে একটা সুন্দর নীলকান্ত মণি বসানো রয়েছে। নীলকান্ত মণি দেখে ছেলেটি চিৎকার করে উঠল-আমার গুণপনা মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। এটা নিশ্চয় আমার গুণমুগ্ধ কোনো ভক্ত পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন আমার নাটকটি আমি শেষ করে ফেলি।
ছেলেটি বেশ খুশি হয়েছে বোঝা গেল। পরের দিন দোয়েলটি বন্দরের দিকে উড়ে গেল। একটা বিরাট জাহাজের মাস্তুলের মাথায়। গিয়ে বসল; দেখল, নাবিকরা সব চিৎকার করতে-করতে জাহাজের খোল থেকে দড়ি বেধে বড়ো-বড়ো পেটি নামাচ্ছে দোয়েল চিৎকার করে বলল–আমি ইডিচল্টে যাচ্ছি। কিন্তু তার কথায় কান দিল না কেউ। তারপরে আকাশে যখন চাঁদ উঠল সে আবার সুখী রাজকুমারের কাছে গিয়ে বলল–আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, দোয়েল, আমার ছোট্ট দোয়েল; তুমি কি আর একটা রাত আমার কাছে থাকবে না?
দোয়েল বলল–এখন শীতকাল; শীগগিরই ঠান্ডা কনকনে বরফ জমবে এখানে। ইজিপ্টে সবুজ পাম গাছের ওপরে সর্য গরম হয়ে উঠেছে। মাটির ওপরে কুমিররা সব শযে অলসভাবে তাকিয়ে রয়েছে পরসপরের দিকে। বলবেক-এর মন্দিরে আমার বন্ধুরা বাসা তৈরি করছে। সাদা আর গোলাপী ঘুঘু পাখিরা তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গুঞ্জন করছে। প্রিয় রাজকুমার, তোমাকে ছেড়ে আমাকে যেতেই হবে; কিন্তু আমি তোমাকে ভুলব না; এবং আগামী বসন্তে যে মণিটি তুমি বিলিয়ে দিয়েছ তার বদলে দুটি সুন্দর মণি তোমাকে এনে দেব। লাল গোলাপের চেয়েও সেই রুবিটা হবে লাল; আর নীলকান্ত মণিটি হবে বিরাট সমুদ্রের চেয়েও অনেক বেশি নীলা।
সুখী রাজকুমার বলল–নীচে ওই পার্কের মধ্যে একটি মেযে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে সে কিছু টাকা না নিয়ে গেলে তার বাবা তাকে মারবে। সেইজন্যেই সে কাঁদছে। তার জুতো বা মোজা লেই। তার মাথা খোলা। তুমি আমার আর একটা চোখ খুবলে মণিটা নিয়ে ওকে দিয়ে এস। তাহলে তার বাবা আর তাকে মারবে না।
দোয়েল বলল তোমার সঙ্গে আর এক রাত্রি থাকতে আমি রাজি হয়েছি কিন্তু তোমার চোখ খুবলোতে রাজি নই। তুমি তাহলে একেবারে অন্ধ হয়ে যাবে।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, দোয়েল, ছোট্ট দোয়েল; আমি যা বলছি তা-ই তুমি কর।
সুতরাং রাজকুমারের আর একটা চোখ সে খুবলে নিল; তারপর সেই চোখটা নিযে সে। তীরবেগে বেরিয়ে গেল। মেয়েটির সামনে নীচু হয়ে তার হাতের চেটোয় ফেলে দিল সেটি।
কী সুন্দর গ্লাসের টুকরো!–সেই বাচ্চা মেযেটা আনন্দে চিৎকার করেই বাড়ির দিকে ছুটে গেল।
তারপর দোয়েল পাখিটা রাজকুমারের কাছে উড়ে এসে বলল–তুমি এখন অন্ধ হয়ে গিয়ে। সেই জন্যে আমি তোমার কাছে সব সময় থাকব।
হতভাগ্য রাজকুমার বলল–না, ছোট্ট দোয়েল; এবার তোমাকে ইজিপ্টে যেতে হবে।
দোয়েল বলল–আমি তোমার কাছে সব সময় থাকব। এই বলে সে রাজকুমারের পায়ের কাছে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের সারাটা দিনই সে রাজকুমারের পিঠের ওপর বসে রইল; বিদেশ-বিভুই-এ সে যা দেখেছে সেই সব গল্প তাকে বলল। সে তাকে লাল সারস পাখিদের কথা বলল–এই সব পাখিরা নীল নদের তীরে লম্বা লম্বা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর গোল্ড ফিশ ধরে। শোনাল পৃথিবীর মতো পুরাতন ফিনিক্সের কাহিনি। হাতে রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে উটের পিছু পিছু হাঁটছে এমন সব বণিকদের কথা বলল, বলল আবলুস কাঠের মতো কালো কুচকুচে চন্দ্ৰপাহাড়ের রাজার কথা, পামগাছের কোটরে যে সব সাপেরা ঘুমোয় তাদের কথা–এই সাপেদের মধুমাখানো পিঠে দিয়ে কুডিটি পুরোহিত ভোজন করায। লম্বা-লম্বা পাতার ভেলায় চড়ে যে সব পিগমিরা বড়ো লেকটার ওপরে ঘুরে বেড়ায় আর সব সময় প্রজাপতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, শোনাল তাদের কথা
রাজকুমার বলল–প্রিয় ছোট্ট দোয়েল, তুমি আমাকে অনেক অদ্ভুত কাহিনি শোনালে; কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা হচ্ছে মানুষের দুঃখ দুঃখের মতো রহস্য আর কিছু নেই। আমার এই শহরের ওপর দিয়ে একবার উড়ে এসে আমাকে বল কী তুমি দেখলে।
সুতরাং উড়ে গেল দোয়েল সেই বিরাট শহরের ওপর দিযে; দেখল ধনীরা তাদের সুন্দর-সুন্দর বাড়িতে আনন্দ করছে; আর তাদেরই ফটকের ধারে বসে রয়েছে ভিক্ষুকরা। সে অন্ধকার গলির মধ্যে উড়ে গিয়ে দেখল ক্ষুধাতুর শিশুগুলি বিবর্ণ মুখে হতাশ চোখে কালো রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পুলের নীচে নিজেদের গরম করার জন্যে দুটি ছেলে জড়াজড়ি করে শুয়ে রয়েছে। তারা বলল–বড় খিদে পেযেছে। পাহারাদাররা ধমক দিল–এখান থেকে ওঠ ওঠা বৃষ্টির ভেতরে বেরিয়ে পড়ল তারা।