চ বলল–ইজিপ্টে বন্ধুরা আমার প্রতীক্ষা করছে। আমার বন্ধুরা নীল নদের ওপরে পাক খেযে-খেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। বড়ো বড়ো কুমুদ ফুলের সঙ্গে গল্প করছে তারা। শীঘ্রই তারা সম্রাটের কবখানার মধ্যে ঘুমোতে যাবে। চিত্ৰবিচিত্র কফিনে সম্রাটও সেইখানে ঘুমোচ্ছেন। নানারকম সুগন্ধী মশলা দিয়ে মাখা বেগনে কাপড়ে ঢাকা রয়েছে তাঁর দেহ। তাঁর গলায় রয়েছে বিবর্ণ জীর্ণ ঘোড়ার একটা শেকল। তাঁর হাত দুটি শুকিয়ে যাওয়া পাতার মতো। রাজপুত্র বলল–দোয়েল, দোয়েল, আমার ছোট্ট দোয়েল, তুমি কি একটা রাত্রি আমার কাছে থাকবে না–হবে না আমার দূত? বাচ্চাটার বড্ড তেষ্টা পেযেছে। বড্ড কষ্ট পাচ্ছে ওর মা।
দোয়েল বলল–ওই সব বাচ্চাদের আমার খুব একটা ভালো লাগে না। গত গ্রীষ্মে আমি যখন নদীতে বাস করছিলাম তখল কলওযালার দুটো বদমাইশ ছেলে সব সময় আমার দিকে ঢিল চুড়তো। সেই সব ঢিল আমার গায়ে অবশ্য লাগেনি। আমরা অনেক দূরে ঘুরে বেড়াই। তা ছাড়া, আমি যে বংশের পাখি তারা ডানার ডোরের জন্যে বিখ্যাত। কিন্তু তবু এটা একটা অসম্মান তো!
কিন্তু সুখী রাজকুমারকে এত বিষণ্ণ দেখাল যে খুদে দোযেলের কেমন কষ্ট হল। সে বলল–জায়গাটা বড়ো ঠান্ডা। তবু আজ রাত্রিতে আমি তোমার কাছে থাকব–কাজ করে দেব তোমার।
রাজকুমার বলল–ধন্যবাদ।
সুতরাং দোয়েল পাখিটি রাজকুমারের তরোয়ালের বাঁট থেকে সেই বড়ো রুবিটা খুলে নিয়ে ঠোঁটে করে অনেক বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
গির্জার উঁচু গম্বুজের পাশ দিয়ে সে উড়ে গেল। সেইখানে দেবদূতদের শ্বেত পাথরে আঁকা মূর্তিগুলি খোদাই করা রয়েছে। সে প্রাসাদের পাশ দিয়ে উড়ে গেল; শুনতে পেল নাচের শব্দ। একটি সুন্দরী মেযে তার প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বারান্দার ওপরে বেরিয়ে এল। প্রেমিকটি তার প্রেমিকাকে বলল–তারাগুলি কী অদ্ভুত সুন্দর! প্রেমের ক্ষমতা কী অদ্ভুত!
মেয়েটি বলল–আশা করি স্টেটবল-এর আমার নতুন পোশাকটা তৈরি হয়ে যাবে। আমি তার ওপরে প্যাশান ফ্লাওয়ার এঁকে দিতে বলেছি। কিন্তু মেয়ে-দর্জিগুলো বড়োই অলস।
সে নদীর ওপর দিয়ে উড়ে গেল; দেখল জাহাজের মাস্তুলের ওপরে লণ্ঠন ঝুলছে। উড়ে গেল। জু’দের বসতির ওপর দিযে; দেখল, তারা দরকষাকষি করে তামার দাঁড়িতে করে টাকা ওজন করছে। অবশেষে সে দরিদ্র কুটিরে হাজির হয়ে উঁকি দিয়ে দেখল। বাচ্চাটা জ্বরের ঘোরে বিছানার ওপরে গড়াচ্ছে। মা তার ঘুমিয়ে পড়েছে-বড়োই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। লাফাতে লাফাতে ঘরের মধ্যে ঢুকে টেবিলের ওপরে যেখানে মেয়েটির সেলাই পড়েছিল তারই পাশে সেই বিরাট রুবিটি রেখে দিল। তারপরে সে ধীরে-ধীরে বিছানার চারপাশে উড়তে লাগল। ছেলেটির কপালে তার ডানা দিয়ে হাওয়া করল। ছেলেটি বলল–আামার গা-টা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমার নিশ্চয় ভত্বর ছেড়ে গিয়েছে। এই বলে মিষ্টি ঘুমের আমেজে সে ঢলে পড়ল।
দোয়েলটি ফিরে এল নিজের জায়গায়, সে যা করেছে সে-সব কথা সুখী রাজকুমারকে বলল। তারপরে মন্তব্য করল–কী অদ্ভুত! যদিও এত ঠান্ডা, তবুও আমার বেশ গরম লাগছে।
রাজকুমার বলল–তার কারণ, তুমি একটা ভালো কাজ করেছ।
এবং সেই ছোট্ট দোয়েলটি চিন্তা করতে-করতে ঘুমিয়ে পড়ল। চিন্তা করতে-করতে সব সময়েই সে ঘুমিয়ে পড়ত।
সকাল হলে সে নদীতে গিয়ে স্নান করে এল। পক্ষীতত্ত্ববিশারদ একটি অধ্যাপক সেই সময় পুলের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। দোয়েলকে দেখে বিস্মিত হয়ে তিনি বললেন–কী অদ্ভুত ঘটনা! শীতকালে দোয়েল! স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে এই নিয়ে তিনি দীর্ঘ একটি চিঠি লিখলেন। প্রত্যেকেই এটি পড়ল, আলোচনা করল; কিন্তু চিঠিতে এত শব্দ ছিল যে তারা তার। বিন্দুবিসর্গও হৃদয়ঙ্গম করতে পারল না।
দোয়েল বলল–আজ রাত্রিতে আমি ইজিপ্ট যাচ্ছি। এই যাওয়ার আনন্দে তাকে বেশ উত্তেজিত দেখা গেল। যত মঠ-মন্দির আর দেখার জায়গা ছিল সব সে দেখে বেড়াল। গির্জার চড়ার ওপরে অনেকক্ষণ ধরে সে বসে রইলা যেখানেই সে গেল সেখানেই চড়াই পাখিরা তাকে দেখে কিচিরমিচির করে নিজেদের ভেতরে বলাবলি করতে লাগল-কী সম্ভ্রান্ত এই বিদেশি পাখি! এইভাবে ঘুরে বেড়িযে সে যথেষ্ট আনন্দ পেলা।
আকাশে চাঁদ উঠলে সে সুখী রাজকুমারের কাছে উড়ে গিয়ে বলল–ইজিপ্টে কাউকে কিছু। বলার রয়েছে তোমার? আমি এবার যাচ্ছি।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, দোয়েল, ছোট্ট দোয়েল–আর একটা রাত্রি কি তুমি আমার কাছে থাকবে না?
দোয়েল বলল–ইজিপ্টে বন্ধুরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আগামীকাল তারা দ্বিতীয় জলপ্রপাত দেখতে যাবে। সেখানে শরগাছের ঝোঁপের মধ্যে নদী-ঘোড়া লুকিয়ে থাকে; আর। গ্রানাইট পাথরের তৈরি বিরাট একটা ঘরের ওপরে মেমনন দেবতা বসে রয়েছেন। সারা রাত্রি ধরে তিনি তারামণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকেন; ভোরের তারা চকচক করে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি আনন্দে একবার চিৎকার করেই শান্ত হয়ে যান। দুপুর বেলা পীতাভ সিংহেরা নদীর ধারে আসে জল খেতো তাদের চোখগুলি সবুজ পান্নার মতো চকচকে; তাদের গর্ডন। উঁচুলপ্রপাতের গর্জনের চেয়েও ডোরাল।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, দোয়েল, ছোট্ট দোয়েল-শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে চিলেকোঠার মধ্যে আমি একটি যুবককে দেখতে পাচ্ছি। কাগজে বোঝাই টেবিলের ওপরে মাথাটি রেখে সে বসে রয়েছে। তার পাশে একটা গামলার ভেতরে রয়েছে কযেকটা শুকলো ভায়লেট ফুল। তার মাথার চুলগুলি কটা আর কোঁকড়ানো। তার ঠোঁট দুটো ডালিমের মতো লাল-বড়ো আর স্বপ্নপু চোখ। থিয়েটারের জন্যে সে একটা নাটক লিখছে; কিন্তু তার এত শীত করছে যে তার হাত সরছে না। তার কামরায় কোনো আগুন নেই। খিদেতে সে বড়ো কাতর হয়েছে।