দোয়েলটি সোজাসুজি কথা বলতে ভালোবাসত। তাই সে জিজ্ঞাসা করল–তোমাকে কি আমি ভালোবাসব? শরগাছটি মাথা নীচু করল তারা তখন সে নদীর ওপরে রূপালি ঢেউ তুলে তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল। এইভাবে সে তার ভালোবাসা জানাল; আর এটা চলল সারা গ্রীষ্মকাল ধরে।
অন্য সব দোয়েল পাখিরা ঠাট্টা করল তাকে–এই ভালোবাসা দেখে হাসি পাচ্ছে আমাদের। মেযেটার কোনো দাম নেই। আত্মীয়-স্বজনেও ওর অনেক। আর নদীটা যে শরগাছে বোঝাই ছিল সেকথা তো মিথ্যে ন্য। তারপরে, শরৎকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা সবাই উড়ে গেল।
বন্ধুরা সবাই চলে গেলে তার বডো একা-একা লাগল। তার প্রেমিকাকে তার আর যেন ভালো লাগল না। সে বললও কোনো কথা বলতে পারে না। তা ছাড়া ও বড়ো ঢঙি। বাতাস একবার বইতে শুরু করলেই ব্যস। ও তার সঙ্গে অমনি ঢঙ করতে শুরু করে দেবে। আর কথাটা সত্যিই। যখনই বাতাস বইত তখনই ও সুন্দর ভাবে কোমর দুলিয়ে তাকে অভিবাদন জানাত। সে বলে গেল–স্বীকার করছি ও ঘরোয়া। কিন্তু নানা দেশ বেড়িয়ে আমার ভালো লাগে; আর আমার স্ত্রীরও সেই রকম বেড়াতে ভালো লাগা উচিত।
সে একবার শেষবারের মতো জিজ্ঞাসা করলচতুমি কি আমার সঙ্গে আসবে? কিন্তু শরটি মাথা নেড়ে বলল–না। ঘরে থাকার মোহ তার এত বেশি।
সে কান্নার সুরে বলল–এতদিন তুমি আমার সঙ্গে ছলনা করেছ। আমি পিরামিডের দিকে উড়ে চললাম। বিদায়! এবং সে উড়ে গেল।
সারা দিন ধরেই সে উড়েছে। রাত্রিতে সে শহরে এসে হাজির হল। সে বলল–কোথায় আমি থাকব? আশা করি এই শহরে থাকার মতো জায়গা নিশ্চয় কোথাও রয়েছে।
তারপরেই লম্বা বেদীর ওপরে সে সেই মূর্তিটা দেখতে পেল। সে বলল–আমি এইখানেই থাকব। বেশ সুন্দর জায়গা পরিষ্কার বাতাসও রয়েছে প্রচুর। এই বলে সে সুখী রাজকুমারের দুটি পায়ের মাঝখানে এসে বসে পড়ল।
চারপাশে তাকিয়ে দেখেই সে বলল–আমার শোওয়ার ঘরটা তো দেখছি সোনার। এই বলেই সে ঘুমানোর ব্যবস্থা করল। কিন্তু সবেমাত্র সে পালকের ভেতরে মাথাটা তার ঢুকিয়ে দিয়েছে এমন সময় বড়ো এক ফোঁটা জল তার গায়ে এসে পড়ল। সে প্রায় চিৎকার করে উঠল–অবাক কাণ্ড! আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই। নক্ষত্রগুলি বেশ পরিচ্ছন্ন আর উজ্জ্বল। তবু বৃষ্টি হচ্ছে? উত্তর ইউরোপের আবহাওঘাটা সত্যিই বড়ো ভয়ঙ্কর। শরগাছ বৃষ্টি বড়ো ভালোবাসত। সেটা। তার স্বার্থপরতা।
আর এক বিন্দু জল পড়ল।
সে বলল–বৃষ্টিই যদি ঠেকাতে না পারল তাহলে স্ট্যাচু থাকার দরকারটা কী? আমাকে একটা চিমনি খুঁজে বার করতে হবে। এই বলেই সে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু উড়ে যাওয়ার জন্যে পাখা দুটো মেলে ধরার আগে তৃতীয় বিন্দুটি পড়ল। সে ওপর দিকে
তাকাল–দেখল-হায়রে, কী দেখল সে?
দেখল, সুখী রাজপুত্রের চোখ দুটি জলে ভর্তি হয়ে গিয়েছে তার সোনালি গাল দুটি বেয়ে সেই জল গড়িয়ে পড়ছে। চাঁদের আলোতে তার মুখটা এতই সুন্দর দেখাচ্ছিল যে সেই ক্ষুদে দোয়েলটির মন করুণায় ভরে গেল। জিজ্ঞাসা করল–তুমি কে?
আমি হচ্ছি সুখী রাজকুমার।
তাহলে তুমি কাঁদছ কেন? এত কাঁদছ যে চোখের জলে আমাকে একেবারে ভিজিয়ে দিয়েছ।
সেই মূর্তিটি বলল–আমি যখন মানুষ ছিলাম, যখন আমার মানুষের হৃদয় ছিল তখন। চোখের জলে কাকে বলে তা আমি জানতাম না। কারণ আমি তখন স্যানসসোসির। রাজপ্রাসাদে বাস করতাম–কোনো দুঃখই সেখানে ঢুকতে পারত না। দিনের বেলায় সঙ্গিদের সঙ্গে আমি বাগানে খেলা করতাম-সন্ধেবেলায় ‘গ্রেট হল’-এ আমি নৃত্য পরিচালনা করতাম। বাগানের চারপাশে ছিল উঁচু পাঁচিল-কিন্তু তার ওপাশে কী রয়েছে তা কোনোদিনই আমি জানতে চাইতাম না। আমার চারপাশে এমন সুন্দর সুন্দর ডিনিস ছড়িয়ে থাকত যে সে সব কিছু জানার প্রয়োজনই আামার হত না। আমার সভাসদেরা আমাকে সুখী রাজকুমার বলে ডাকতেন আর আনন্দটা যদি সুখ হয় আমি তাহলে সত্যিই সুখী ছিলাম। এইভাবেই আমি বেঁচে ছিলাম, আর এইভাবেই আমি একদিন মারা গেলাম। আমি মারা যাওয়ার পরে তারা। আমাকে এত উঁচু বেদীর ওপরে বসাল যে আমার শহরের সমস্ত কদর্যতা আর দুঃখ আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি। আর যদিও আমার হৃদযটা ওরা সীসে দিয়ে তৈরি করেছে তবু আমি না কেঁদে পারছি লে।
দোয়েল পাখি নিজের মনে-মলেই বলল–কী! ওর সমস্তটা কি সোনা নয়?
সে এতটা নম্র ছিল যে এই ব্যক্তিগত মন্তব্যটা সে চেঁচিয়ে বলতে পারল না।
আস্তে-আস্তে সুরেলা কণ্ঠে মূর্তিটি বলল–অনেক দূরে–অনেক দূরে রাস্তার ওপারে একটা কুঁড়ে রয়েছে। ওই ঘরের একটা জানালা খোলা। তারই ভেতর দিয়ে একটি মহিলাকে আমি। টেবিলের পাশে বসে থাকতে দেখছি। তার মুখটা রুগ্ন, ক্লিষ্ট। তার হাত দুটি লাল খসখসে, দুচে বেঁধা–কারণ মেয়েটি পেশায় দর্জিা রানির সব চেয়ে সুন্দরী একটি সহচরী পরবর্তী ‘কোর্ট বল’-এ নাচবে। তারই জন্যে সার্টিনের গাউনের ওপরে সে ‘প্যাশান ফ্লাওয়ার’ আঁকছে তার ঘরের এক কোণে তার শিশুটি অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। তার জ্বর হয়েছে। সে কমলালেবু খেতে চাইছে। নদীর ভাল ছাড়া তাকে আর কিছু খেতে দেওয়ার সামর্থ্য তার মাযের নেই। তাই সে কাঁদছে। দোয়েল দোয়েল, আমার ছোট্ট দোয়েল, আমার তরোয়ালের বাঁটের ওপরে যে রুবিটা রয়েছে সেটা কি তুমি তাকে একটু দিয়ে আসবে না? আমার পা দুটো এই মাঁচার সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। আমি যে নড়াচড়া করতে পারি নে।