হিউজি ভেতরে ঢুকেই দেখল ট্রেভর একটি অপরূপ প্ৰমাণ মাপের ভিক্ষুকের ছবির ওপরে শেষ তুলি বোলাচ্ছে স্টুডিয়োর এক কোণে একটি উঁচু বেদীর ওপরে স্বয়ং ভিক্ক মডেল হয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখের চামড়া চুপসে গিয়েছে, বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে তার সর্বাঙ্গে, তার সারা দেহের ওপরে করুণ আর্তির একটা মূৰ্জনা ছড়িয়ে পড়েছে। তার কাঁধের ওপরে চাপা রয়েছে একটা ডো ময়লা চাদর। তার মোটা কুর্তা তালি আর তাপ্তিতে ভরে উঠেছে। একটা হাত দিয়ে সে ছডির ওপরে ভর করে রয়েছে, আর একটা হাতে ডো টুপিটা বাড়িয়ে দিয়েছে ভিল্কের আশায়।
বন্ধুর সঙ্গে করমর্দন করে হিউজি বলল–কী অদ্ভুত মডেল!
খুব জোরে চিৎকার করে উঠল ট্রেভর–অদ্ভুত মডেল? আমারও তাই ভাবা উচিত। এইরকম ভিক্ষুকের দেখা রোজ পাওয়া যায় না। এইটিই আমার নতুন আবিষ্কার! হায় ভগবান, রেমব্রনত একে পেলে কী অদ্ভুত ছবিই না আঁকতেন?
হিউজি বলল: হতভাগ্য মানব! কী করুণই না দেখাচ্ছে ওকে। কিন্তু মনে হচ্ছে তোমার মতো চিত্রকরের কাছে ওর মুখটাই ওর সৌভাগ্য বয়ে আনবে।
ট্রেভর বলল: নিশ্চয়! কোনো ভিক্ষুক সুখী হোক তা তুমি নিশ্চয় চাও না! চাও কি?
আরাম করে বসে হিউজি জিজ্ঞাসা করল–এইরকম মডেল হওয়ার জন্যে ওরা কত করে পায়?
ঘয় এক শিলিং।
এই ছবিটার জন্যে তুমি কত পাবে?
তা দু’হাজার
পাউন্ড?
গিনি। চিত্রকর, কবি, আর ডাক্তাররা সব সময় গিনি পায়।
হাসতে-হাসতে হিউভি বলল–আমার মনে হয় তার একটা ভাগ মডেলদেরও পাওয়া উচিত। তাদেরও তোমাদের মতো কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।
বোকা কোথাকার! সারাদিন ইলেজের সামনে দাঁড়িযে রঙ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটা যে কী কষ্টকর সেটা তোমার ভেবে দেখা উচিত। আমার মনে হয় হিউজি, আর্ট মাঝে মাঝে মাটি কোপানোর মতো পরিশ্রম পরিণত হয়। কিন্তু এখন আর বকবক করো না। চুপচাপ সিগারেট খাও। বর্তমানে খুব ব্যস্ত রয়েছি আমি।
কিছুক্ষণ পরে চাকর এসে সংবাদ দিল একজন ছবি বাঁধাইকারী তার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
বেরিয়ে যেতে-যেতে ট্রেভর বলল–হিউজি, তুমি পালিয়ে যেও না-আমি এখুনি আসছি।
ট্রেভর বেরিয়ে যেতেই বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে তার পেছনে রাখা একটা বোঞ্চের ওপরে একটু বসল। তাকে এত দুঃখী আর অবসন্ন মনে হল যে তার ওপরে কেমন যেন মায়া হল হিউজির। সঙ্গে সঙ্গে সে তার পকেটে হাত দিয়ে দেখল মাত্র একটি সভারেল আর কিছু তামার পেনস রয়েছে তার পকেটে। নিজের মনে-মনেই সে বলল–বৃদ্ধ দরিদ্র; আমার চেয়ে ওর প্রযোজনটাই বেশি–যদিও এর অর্থ হচ্ছে হেঁটেই আমাকে বাড়িতে ফিরতে হবে।
এই ভেবে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভিক্ষুকের হাতে সভারেনটা খুঁজে দিল সে।
বৃদ্ধটি চমকে উঠল; একটা ছোট্ট হাসি খেলে গেল তার শুকনো ঠোঁটের ওপরে।
সে বলল–ধন্যবাদ স্যার, ধন্যবাদ!
তারপরে ফিরে এল ট্রেভরা সভারেনটা বিলিয়ে দেওয়ার জন্যে একটু লজ্জিত হয়ে বিদায় নিল হিউজি লরার কাছে সারাদিন কাটাল; এই অমিতব্যয়িতার জন্যে লরার কাছ থেকে মিষ্টি ধমক খেল একটা; এবং তারপরে, বাড়ি ফিরে গেল হেঁটে।
সেইদিনেই সন্ধের সময় প্রায় এগারোটা নাগাদ সে বেড়াতে-বেড়াতে প্যালেট ক্লাবে হাজির হল। দেখল, ধূমপানের ঘরে ট্রেভর বসে মদ খাচ্ছে।
একটা সিগারেট ধরিযে হিউজি বলল–ছবিটা বাঁধানো হয়ে গিয়েছে তো হে?
ট্রেভর বলল–হয়েছে। হ্যাঁ শোন, তোমারই তো লাভ হয়েছে বেশি। সেই বৃদ্ধ মডেলটির খুব ভালো লেগেছে তোমাকে। তাকে তোমার বিষযে সব কথাই আমাকে বলতে হয়েছে। তোমার আয় কত, ভবিষ্যৎ কী-ইত্যাদি ইত্যাদি…
চেঁচিয়ে উঠল হিউজি-বল কী হে? বাড়ি গিয়ে আমি হয়তো দেখব আমার জন্যে সে অপেক্ষা করে বসে আছে। অবশ্য তুমি ঠাট্টা করছ। হতভাগ্য বৃদ্ধ! ইচ্ছে যায় তার জন্যে আমি কিছু করি। আমার ধারণা, এই রকম দারিদ্র যে-কোনো মানুষের পক্ষেই বিপজ্জনক। বাড়িতে। আমার অনেক পুরনো পোশাক রয়েছে। তোমার কি মনে হয় সেগুলোর কিছু তার পছন্দ হবে? ওর পোশাক ছিঁড়ে একেবারে কুটিকুটি হয়ে গিয়েছে।
ট্রেভর বলল–কিন্তু ওই পোশাকেই ওকে বড়ো চমৎকার দেখায়। ফ্ৰককোট পরলে কোনো। কিছুর মোহেই আমি ওর ছবি আকতে যেতাম না। তুমি যাকে ডো পোশাক বল তাকেই আমি বলি রোমান্স। তোমার কাছে যেটাকে দারিদ্র্য বলে মনে হয় আমার কাছে সেইটাই অপরূপ সুন্দর। যাই হোক, তোমার এই প্রস্তাব তাকে জানাব।
হিউজি বেশ গম্ভীরভাবেই বলল–চিত্রকরেরা বড়োই নিষ্ঠুর।
ট্রেভর বলল–আর্টিস্টের হৃদয় হচ্ছে তাদের মাথা। আর তাছাড়া, আমাদের ব্যবসাটাই হচ্ছে পৃথিবীটি যে রকম ঠিক সেই রকম ভাবেই তাকে দেখা। তাকে সংস্কার করা আমাদের কাজ ন্য। প্রত্যেক মানুষকেই তার নিজের নিজের ব্যবসা দেখতে হবে। এখন বল, লরা কেমন। আছে। বৃদ্ধ মডেলটি তার সম্বন্ধে অত্যন্ত উৎসুক হয়ে উঠেছে।
তার কাছে লরার সম্বন্ধে তুমি আলোচনা করে একথা নিশ্চয়ই তুমি বলছ না?
নিশ্চয় বলছি। দুর্দান্ত কর্নেল, সুন্দরী লরা, আর দশ হাজার পাউন্ড–এই সমস্ত কথা সে জানে।
রেগে লাল হয়ে উঠল হিউজি–আমার সব ঘরোযা কথা তাকে তুমি বলেছ?
ট্রেভর হেসে বলল–প্রিয় বৎস, ওই বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি হচ্ছেন বিশ্বের একজন শ্রেষ্ট ধনী। ব্যাঙ্কের কাছ থেকে কোনো ধার না করেই কালই তিনি গোটা লন্ডন শহরটা কিনে ফেলতে পারেন। প্রতিটি রাজধানীতে তাঁর একটি করে বাড়ি রয়েছে, সোনার প্লেটে তিনি খান; এবং ইচ্ছা হলে রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেন।