রাত্রি প্রায় দুটোর সময় তিনি উঠলেন। হাঁটতে লাগলেন ব্ল্যাকফ্রায়ার্স এর দিকে। কত অপার্থিব, কত স্বপ্নমযই না সব দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে নদীর উলটো দিকে বাডিগুলি সব অন্ধকার দিয়ে তৈরি হয়েছে। দেখলে মনে হবে রুপো আর ছায়া দিয়েই বিশ্বটা তৈরি হয়েছে। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাসের মধ্যে সেন্ট পলের উঁচু গম্বুজটাকে একটা বুদবুদের মতো মনে হল।
ক্লিয়োপেট্রার নিডল-এ এসে পৌঁছতেই তিনি দেখতে পেলেন একটা লোক কার্নিশের ওপরে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। কাছাকাছি আসতেই লোকটি ওপর দিকে তাকাল। সেই সময় গ্যাসের আলোটা তার মুখের ওপরে গিয়ে পড়ল।
লোকটি আর কেউ নন, মিঃ পডগারস, সেই গণৎকার। সেই থ্যাবড়া, থলথলে মুখ, সোনা দিয়ে বাঁধালো চশমা, রুগ্ন হাসি, আর কামার্ত মুখের চেহারা দেখে অন্য লোক বলে ভুল হওয়ার উপায় নেই কারও।
লর্ড আর্থার দাঁড়িয়ে পড়লেন। মগড়ের মধ্যে একটা চমৎকার চিন্তা খেলে গেল তাঁরা নিঃশব্দে তিনি তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপরে ঝটিতি তাঁর পা দুটো ধরে সোডা তিনি তাঁকে টেমস নদীর জলে ফেলে দিলেন। একটা গালাগালির শব্দ শোনা গেল; তারপরেই শোনা গেল ঝপাং করে একটা জিনিস জলে পড়ার শব্দ। তারপরেই সব চুপচাপ। অস্থিরচিত্তে লর্ড আর্থার সেই দিকে চেয়ে রইলেন। কিন্তু গণৎকারের আর কিছুই দেখা গেল না। শুধু তাঁর উঁচু টুপিটা চন্দরকরোজ্জ্বল নদীর জলে নাচতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে তাও গেল তালিযে। মিঃ পডগারস-এর কোনো চিহ্ন আর দেখা গেল না। একবার মনে হল তাঁর বিকৃত দেহটা পোলের সিড়িঁটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু তারপরেই মন হল ওটা ছায়া ছাড়া আর কিছু নয়। আকাশে চাঁদ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়াটাও মিলিয়ে গেল। ভাগ্যের বিধান কী ছিল এবার তিনি তা যেন বুঝত পারলেন। একটা বিরাট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপরেই সাইবিলের নামটা তাঁর ঠোঁটের ডগায় এসে উপস্থিত হল।
পরের কটা দিন আশা আর ভয়ের আবর্তে তিনি পাক খেতে লাগলেন। মাঝে-মাঝে তাঁর মনে হত এই বুঝি মিঃ পডগারস তাঁর ঘরে এসে হাজির হন। কিন্তু অন্য সময় তাঁর মনে। হত-না; ভাগ্য কি তাঁর ওপরে এত নির্দয় হতে পারে? দু’দুবার তিনি গণৎকারের বাড়ির সামলে গেলেন; কিন্তু কিছুতেই বেল বাজাতে পারলেন না। তিনি নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভয়ে সেকথা কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারছিলেন না।
অবশেষে সংবাদ এল। চা খাওয়ার পর ক্লাবের ধুমপান করার ঘরে তিনি বলেছিলেন এমন সময় বেহারা কয়েকটি কাগজের সান্ধ্য সংস্করণ নিয়ে হাজির হল। সেন্ট জেমস কাগজটা। তুলে নিয়ে তিনি চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় একটা বেশ বড়ো অক্ষরে ছাপা বিশেষ একটি সংবাদ তাঁর চোখে পড়ল।
গণৎকারের আত্মহত্যা
উত্তেজনায় কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেলেন তিনি। তাড়াতাড়ি পড়তে লাগলেন। সংবাদিট হচ্ছে —
গতকাল সকালে সাতটার সময় মিঃ সেপটিমাস আর, পডগারসবিখ্যাত হস্তপরীহক-এর। মৃতদেহ গ্রীনউইচ উপকূলে পাওয়া গিয়েছে, শ্যিপ হোটেলের ঠিক সামনেই হতভাগ্য ভদ্রলোককে কয়েকদিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। গণৎকারদের সমাজে তাঁর জন্যে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছিল। মনে হচ্ছে সামরিক মস্তিষ্ক বিকারের ঝোঁকে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। হয়তো, অতিরিক্ত পরিশ্রমই এর জন্যে দায়ী। করোনাররাও এই মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। মিঃ পডগারস সম্প্রতি ‘মানুষের হাত’–এই বিষয়ে একটি বিশদ পুস্তক রচনার কাজ শেষ করেছেন। সেটি শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। হলে, একটা আলোড়নের সৃষ্টি হবে চারপাশে। মৃত ব্যক্তির বয়স ছিল পঘষট্টি বছর। তাঁর কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই বলেই আমাদের মনে হয়।
কাগজটা হাতে নিয়ে লর্ড আর্থার ক্লাব থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন। তারপরেই সোডা পার্ক লেন। জানালা থেকে সাইবিল তাঁকে দেখলেন। দেখেই তাঁর মনে হল নিশ্চয় কোনো শুভ সংবাদ রয়েছে। তাড়াতাড়ি নেমে এলেন তিনি। আর্থারের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি। বুঝলেন–হ্যাঁ, সংবাদটা শুভই।
লর্ড আর্থার বললেন–প্রিয় সাইবিল, কালকেই আমরা বিয়ে করব।
চোখের জলে হাসতে হাসতে সাইবিল বললেন–বোকা ছেলে! এখনো কেক তৈরি করার জন্যে বাঘনা দেওয়া হয়নি যে।
.
০৬.
তিন সপ্তাহ পরে বিয়ে হল তাঁদের। এই উপলক্ষে সেন্ট পিটার গির্জায় চটপটে আধুনিক যুবক-যুবতীর বেশ ভালোই সমাবেশ হয়েছিল। চিচেস্টারের ডিন গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করলেন। এরকম সুন্দর পাত্র-পাত্রী ও অঞ্চলে আর কখনো যে। দেখা যায়নি সে বিষয়ে সবাই একমত। সাইবিলের জন্যে লর্ড আর্থার যে কষ্ট করেছেন সেকথা একবারও তাঁর মনে হল না। আর নারী তার শ্রেষ্ঠ জিনিস পুরুষকে যা দিতে পারে-সেবা, যত্ন আর ভালোবাসা-সাইবিল যে-সবই আর্থারকে দিয়েছিলেন। তাঁদের ভীবনে বাস্তবের সংঘাতে রোমান্স চূর্ণ হয়নি। চিরকালই তাঁদের যৌবন অটুট ছিল।
কয়েক বছর পরের কথা। তখন তাঁদের সুন্দর দুটি সন্তান জন্মেছে। লেডি উইনডারমিয়ার একদিন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন অ্যালটন প্রযোরিতো জায়গাটা বড়ো সুন্দর। ডিউক যৌতুক হিসাবে এই জায়গাটা তাঁর পুত্রকে দান করেছিলেন। একদিন বিকালে বাগানের একটা লাইম গাছের তলায় লেডি উইনডারমিয়ার লেডি আর্থারের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন। ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটি গোলাপ বাগানের ভেতরে খেলা করছিল। এমন সময় হঠাৎ সাইবিলের হাতটা ধরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-তুমি সুখী হচ্ছে, সাইবিল?