নিশ্চয়-নিশ্চয়-এই বলে হ্যানস দৌড়ে গিয়ে তক্তাগুলি টেনে আনল।
সেই দিকে তাকিয়ে মিলার বলল–তা তো বেশ বড়ো নয় হে। ভয় হচ্ছে আমার চাল সারানোর পরে এমন কিছু তক্তা বাঁচবে না যা দিয়ে তোমার ঠেলাগাড়ি সারানো চলবে। অবশ্য তার জন্যে আমি দায়ী নই। এখন আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দিয়ে দিলাম। তারই প্রতিদানে নিশ্চয় তুমি আমাকে কিছু ফুল দেবে। এই নাও ঝুডি, ওটা ভর্তি করে দিতে ভুলো না যেন।
একটু দুঃখিত হয়ে হ্যানস জিজ্ঞাসা করল–ভর্তি?
সে জানত অতবড়ো ঝুড়ি ভর্তি করতে গেলে বাগানে তার আর কোনো ফুলই থাকবে না; অথচ তার রুপোর বোতামটা ফিরিয়ে আনার জন্যে ফুল নিয়ে তখনই বাজারে যাওয়া চাই।
মিলার বলল–তোমাকে আমি ঠেলাগাড়িটা দিয়ে দিলাম। তার বদলে কযেকটা ফুল চাওয়াটা এমন কিছু বেশি নয়। আমার হয়তো ভুল হয়েছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম সত্যিকার বন্ধুত্বের মধ্যে দেনা-পাওনার ব্যাপারটা একেবারেই গৌণ।
খুদে হ্যানস বলল–প্রিয় বন্ধু নিয়ে যাও আমার বাগানের সব ফুল। আমার রুপোর বোতামের। চেয়ে তোমার উপদেশ অনেক বেশি মূল্যবান।
এই বলে সে সেই বিরাট ঝুড়ি নিয়ে ফুলে সেটা বোঝাই করে দিল।
বিদায় হ্যানস–এক কাঁধে তক্তা আর এক হাতে ঝুড়িটা নিয়ে মিলার বিদায় নিল।
পরের দিন সে যখন বাগানে কাজ করছিল এমন সময় পিঠে বিরাট একটা ময়দার বোঝা নিযে মিলার তার বাগানের ধারে এসে হাজির হল, বলল–প্রিয় হ্যানস, এই বোঝাটা আমার হয়ে তুমি একটু বাজারে বয়ে নিয়ে যাবে?
হ্যানস বলল–সত্যিই আমি খুব দুঃখিত। আজ আমার অনেক কাজ রয়েছে বাগানে।
মিলার বলল–সত্যিই আমাকে অবাক করলো তোমায় ঠেলাগাড়িটা দেব এই কথা শুনেও কি এটুকু কাজ না করাটা তোমার পহেষ্ক অবন্ধুর কাজ করা হবে না?
হ্যানস চিৎকার করে বলল–আর ওকথা বলো না। সমস্ত পৃথিবীর বিনিমযেও আমি অবন্ধুর মতো কাজ করব না। চল।
দিনটা সত্যিই গরম ছিল। শুধু যে ভীষণ গরম তাই নয় একেবারে ধুলোতে ভর্তি। কিছুটা গিয়েই সে এত ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে বিশ্রামের জন্য তাকে বসে পড়তে হল। তা সত্ত্বেও সে বীরত্বের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে একসময় বাজারে পৌঁছল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে বেশ ভালো দামে সে ময়দা বিক্রি করে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরল; কারণ তার ভয় হল রাত হয়ে গেলে পথে সে দস্যুদের কবলে পড়তে পারে।
ঘুমোতে যাওয়ার সময় খুদে হ্যানস নিজের মনে-মনেই বলল–আডং সারা দিনটাই খুব পরিশ্রম হয়েছে। কিন্তু মিলারের কাজ করতে আমি যে অস্বীকার করিনি সেটা ভালোই হয়েছে, কারণ, মিলারই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তাছাড়া সে আমাকে তার ঠেলাগাড়িটা দেবে বলেছে।
পরের দিন খুব ভোরেই ময়দার দাম নেওয়ার জন্য মিলার তার বাড়িতে এসে হাজির হল কিন্তু ক্লান্ত হ্যানস তখনো বিছানা থেকে ওঠেনি।
মিলার বলল–তুমি বড়োই অলস হয়ে উঠচ্ছা সত্যি বলতে কি, তোমায় আমি আমার ঠেলাগাড়িটা দেব বলেছি। বিশেষ করে সেই জন্যেই তোমার কঠোর পরিশ্রম করা উচিত। আলস্য হচ্ছে মহা পাপ। আমার বন্ধুরা কেউ অলস হোক তা আমি চাই নে। সম্পষ্ট কথা বলছি বলে কিছু মনে করো না। তোমাকে যদি বন্ধু বলে না ভাবতাম তাহলে এসব কথা বলার চিন্তাও আমি করতাম না। কিক্তি মনের কথাটা প্রকাশ করে যদি বলতেই না পারলাম তাহলে বন্ধু হয়ে আর কী লাভ আমার? ইত্যাদি ইত্যাদি।
চোখ রগড়াতে খদে হ্যানস বিছানায় উঠে বসে বলল–সত্যিই বড়ো দঃখিত: কিন্তু গতকাল আমি এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে ভাবলাম আজ একটু বেশিক্ষণ শুয়ে থেকে পাখির গান শুনব। পাখির গান শোনার পরে আমার কাজ করার শক্তি অনেক বেড়ে যায় তা কি তুমি জান?
খুদে হ্যানস-এর পিঠে চাপড় দিযে মিলার বলল–তোমার কথা শুনে খুশি হলাম। তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে আমার মিল-এ এস। ছাতাটা সারিয়ে দিতে হবে।
ফুলগাছ দু’দিন জল পায়নি; বেচারা হ্যানস-এর তাড়াতাড়ি বাগানে যাওয়া দরকার, যে এমন সৎ বন্ধু যে মিলারকে নিরাশ করতে তার ইচ্ছে যাচ্ছিল না।
একটু লজ্জিতভাবে সে বলল–আজ আমি ব্যস্ত রয়েছি। না গেলে কি কিছু মনে করবে?
মিলার বলল–এ কী বলছ! তোমাকে আমি ঠেলাগাড়িটা দেব বলছি। তারপরে একাজটা করে দেওয়ার জন্যে তোমাকে কিছু বলারই আমার দরকার রয়েছে বলে ভাবিনি। কিন্তু যদি তুমি। যেতে অস্বীকার কর তাহলে অগত্যা নিজেই করে নেব।
হ্যানস তাড়াতাড়ি বলল–না, না। আমি এখনই যাচ্ছি।
এই বলেই সে লাফিয়ে উঠে জামাকাপড় পরতে এগিয়ে গেল।
মিলার উৎসাহিত হয়ে বলল–অপরের কাজ করে দেওযার মতো নযুলাভিরাম কাজ আর নেই।
সারাদিন কাজ করার পর সন্ধের সময় বিশ্রাম নিতে-নিতে আর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হানস বলল–তুমি যা বল তা শোনা পরম উপাদ্যে। কিন্তু তোমার এই সুন্দর আদর্শের কথা কোনোদিনই যে আমার মাথায় আসবে আমি ভাবতে পারিনি।
মিলার সাহস দিয়ে বলল–আসবে, আসবে, কিন্তু আরো কষ্ট করতে হবে তোমাকে। বন্ধুত্ব কাকে বলে তা শিখতে এইতো সবে শুরু করে। একদিন আসবে যখন সব বুঝতে পারবে তুমি।
পারব? সত্যি বলছ?
নিঃসন্দেহে। কিন্তু আজ তুমি বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করা কাল সকালে আমার মেষগুলোকে চরাতে নিয়ে যেতে হবে।
বেচারা হ্যানস এর প্রতিবাদ করতে ভয় পেল। পরের দিন সকালেই মিলার তার একপাল মেষ নিয়ে হাজির হল তার বাগানের ধারে। সেই পাল নিযে হ্যানস ছুটল পাহাড়ের ওপরে। সারাদিন মেষ চরিয়ে ফিরে এল সন্ধেবেলায়; কিন্তু তখন সে এত ক্লান্ত যে চেয়ারে বসেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল হওয়ার আগে আর তার ঘুম ভাঙেনি।