সত্যি কথা বলতে কি আমার সঙ্গে তোমার থাকা উচিত ছিল। কাঁধের ওপরে চামড়ার কালো ভিস্তি নিয়ে কেউ মদ বিক্রি করার জন্যে ভিড় ঠেলে ঠেলে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। অধিকাংশ মদের ব্যবসাদাররাই বিক্রি করছিল মধুর মতো মিষ্টি স্কিরাজ-এর মদ। বাজারে ফলওয়ালারা কত। রকমের ফলই না নিয়ে বসেছিল বিক্রি করার জন্যে! একবার একটা হাতি আমার চোখে পড়ল। তার শুডটা সিঁদুর আর হলুদে চিত্রিত। কানের ওপরে লাল সিল্কের দডি জড়ানো। হাতিটা একটা দোকানের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে কমলালেবু খেতে লাগল। তাই দেখে হাসতে লাগল দোকানদার। তারা যে কী অদ্ভুত ধরনের মানুষ সেকথা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আনন্দ হলে তারা কোনো পাখি-বিক্রির দোকানে গিয়ে খাঁচাসুদ্ধ পাখি কিনে আনে; তারপরে তাকে খাঁচা খুলে আকাশে উড়িয়ে দেয়। এতে তাদের আনন্দ আরো বেশি হয়। দুঃখ হলে যাতে, তাদের দুঃখ না কমে সেই জন্যে নিজেদের তারা কাঁটাগাছের চাবুক মারে।
একদিন সন্ধেবেলা দেখলাম কয়েকজন নিগ্রো একটা ভারী পালকি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রঙ করা। বাঁশ দিয়ে সেটা তৈরি; এর ডাণ্ডাগুলির মাথায় সীসের মযুর বসানো। জানালার ওপরে টাঙানো সূক্ষম মসলিনের পর্দা। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি সিরকাসিযেন মহিলা বিবর্ণমুখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। আমাকে দেখে নিগ্রোরা দাঁত খিচোল। কিন্তু আমার এতই কৌতূহল হয়েছিল যে আমি তাদের দাঁত খিচোনিকে গ্রাহ্য করলাম না।
তারপরে তারা একটা সাদা চৌকো ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালা এ ঘরে কোনো জানালা ছিল না; ছিল কবরের ভেতরে ঢোকার মতো একটা ফুটো। সেইখানে পালকিটা নামিয়ে একটা তামার হাতুড়ি দিয়ে বার-তিনেক তারা মাটি ঠুকল। একজন আর্মেনিয়ান তাদের দেখে দরজা খুলে একটা কার্পেট বিছিযে দিল। মহিলাটি বাইরে বেরিয়ে এল। ভেতরে ঢোকার সময় আমার দিকে তাকিয়ে সে আবার একটু হাসল। এত বিবর্ণ মুখ জীবনে আর কখনো আমি দেখিনি।
চাঁদ উঠলে আমি আবার সেখানে গেলাম; সেই বাড়িটা খুঁজলাম; কিন্তু কোনো বাডি চোখে পড়ল না। তখনই আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটি কে, আর কেনই বা সে আমাকে দেখে হেসেছিল।
সত্যিই বলছি আমার সঙ্গে তোমার থাকা উচিত ছিল। অমাবস্যার দিন ওখানে যে ভোজের উৎসবর হয় সেইদিন প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যুবক রাজকুমার প্রার্থনা করার জন্যে মসজিদে। ঢুকলেন। সূর্যোদয়ের সময় রুপোর পোশাক পরে তিনি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন; সন্ধের সময় সোনার পোশাক পরে আবার তিনি ফিরে এলেন। জনতা তাঁর সামনে লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে নিজেদের মুখ ঢাকল, আমি কিন্তু তা করলাম না। একটা খেজুরের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাকে দেখে সম্রাট তাঁর চিত্রিত ভুরু দুটি তুলে থেমে গেলেন। আমি তবু দাঁড়িয়ে রইলাম। তাঁকে সেলাম জানালাম না। আমার এই দুঃসাহসে সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল; আমাকে পালিয়ে যাওয়ার উপদেশ দিল। তাদের দিকে গ্রাহ্য না করে আমি কতগুলি ঘৃণ্য দেবতার স্টলে গিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে বসে রইলাম। আমি কী করছই তা শুনে তাদের প্রত্যেকেই একটা দেবমূর্তি আমার হাতে দিয়ে তাদের কাছ থেকে সরে যেতে তারা আমাকে অনুরোধ জানাল।
সেইদিন রাত্রিতে ডালিম গাছে ভরা একটি রাস্তার ওপরে চা-এর দোকানে জাজিমের ওপরে আমি শুয়েছিলাম। এমন সময়ে সম্রাটের রন্ধীরা ঘরে ঢুকে আমাকে প্রাসাদে নিয়ে গেল। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ঘরের দরজা তারা বন্ধ করে শেকল এঁটে দিল। ভেতরে বিরাট একটা দরবার। তার চারপাশে বিরাট-বিরাট থামের ওপরে খিলান বসানো। দেওয়ালগুলি স্ফটিক পাথর দিয়ে তৈরি–মাঝে মাঝে নীল আর সবুজ টালি বসানো। এ রকম জায়গা এর আগে আমি কোনোদিন দেখিনি। দরবার দিয়ে যাওয়ার সময় ঘোমটায় ঢাকা দুটি মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে অভিসম্পাত দিল। প্রহরীরা দ্রুত হাঁটতে লাগল। তাদের বর্শার বাঁটগুলো মসৃণ মেঝের ওপরে লেগে শব্দ করতে লাগলা হাতির দাঁতের একটা দরজা খুলে তারা ভেতরে এল। দেখলাম আমি একটি জলসিক্ত বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে। রয়েছি। এর ছাদ হচ্ছে সাতটা। একটা বাগান থেকে নাইটিংগেল পাখির গান শোনা যাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পরে প্রহরীদের দলপতি সবাইকে সরিয়ে দিতেই তারা সব প্রাসাদের দিকে ফিরে গেল। বাগানের শেষে একটা তাঁবু ছিল। তাদের বিদায় করে দলপতি আমাকে সেই তাঁবুর দিকে যাওয়ার জন্যে ইশারা করল। নির্ভয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। তারপরে ভারী পর্দা সরিয়ে
ভেতরে ঢুকে গেলাম। যুবক সম্রাট রঙ করা সিংহের চামড়ায় ঢাকা একটা সোফার ওপরে। শুয়েছিলেন। তাঁর পেছনে সীসের পাগড়ি চাপিয়ে একজন নুবিযার ক্রীতদাস দাঁড়িয়েছিল। তার দু-ফাঁককরা কালের ওপরে দুটো বেশ ভারী মাকড়ি ঝুলছিল। সোফার পাশে ছিল একটা টেবিল। সেই টেবিলের ওপরে ছিল ইস্পাতের তৈরি বিরাট একখানা তরোযাল।
আমাকে দেখে সম্রাট ভ্রূকুটি করে ডিজ্ঞাসা করলেন–তোমার নাম কী? তুমি কি জান না আমি এখানকার সম্রাট? কিন্তু আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
তিনি তখন সেই তরোয়ালটার দিকে আঙুল বাড়ালেন। এই দেখ সেই ক্রীতদাসটি সেটাকে তুলে নিয়ে ভীষণ জোরে আমাকে আঘাত করল। হুইস-হুঁইস শব্দে তরোয়ালের মুখটা। আমার ভেতর দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল। কিন্তু আমার কোনো ক্ষতি করল না। এই দেখে লোকটা মেঝের ওপরে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেল। যখন সে উঠল তখন তার দাঁতে দাঁত বসে গিয়েছে; সোফার পেছনে ভযে সে লুকিয়ে পড়ল। এই দেখে দাঁড়িয়ে উঠলনে সম্রাট ঘরের একপাশে কয়েকটা অস্ত্র দাঁড় করানো ছিল। সেখান থেকে একটা বর্শা তুলে নিয়ে। আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। সেটা আমি ধরে ফেলে দু-আধখানা করে ফেললাম। তিনি একটা তীর ছুঁড়লেন; কিন্তু আমি হাত দুটো আকাশে তোলার সঙ্গে সঙ্গে তীরটাও মাঝখানে থেমে গেল। তখন তিনি কোমরবন্ধনী থেকে একটা ছোরা বার করে সেই ক্রীতদাসটির গলায় নলি কেটে দিলেন। তাঁর ভয় হচ্ছিল তাঁর অপমানের কথা যদি সে বাইরে প্রকাশ করে দেয়। লোকটা কাটা সাপের মতো মেঝের ওপর ন্যাকপ্যাক করতে লাগল; মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। সাদা গ্যাঁজলা।