একটু পরে আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-কী চাই তোমার?
আমি বললাম–দেবতাকে দেখতে চাই।
তাঁর সেই তেবচা ছোটো চোখে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে তিনি বললেন–দেবতা শিকার করছেন।
বললাম-কোন বনে শিকার করছেন বলুন; আমি তাঁর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে শিকার করব।
লম্বা নখ দিয়ে তাঁর ঢিলে পোশাকটা চেঁছে তিনি বললেন–দেবতা ঘুমোচ্ছেন।
জিজ্ঞাসা করলাম–কোন সোফায় ঘুমোচ্ছেন বলুন। আমি তাকে ঘুমোতে দেখব।
তিনি চেঁচিয়ে বললেন–দেবতা এখন ভোজনাগারে খাচ্ছেন।
বললাম-মদ যদি মিষ্টি হয় তাহলে তাঁর সঙ্গে আমি মদ খাব। তেতো হলেও পিছিয়ে আসব না।
বিস্ময়ে তিনি মাথাটা নীচু করে আমাকে হাত ধরে তুললেন; তারপরে মন্দিরে নিয়ে গেলেন আমাকে।
প্রথম ঘরে দেখলাম একটা সিংহাসনের ওপরে একটি মূর্তি বসানো রয়েছে। সিংহাসনটি মূল্যবান ধাতুতে তৈরি। তার চারপাশটা প্রাচ্যদেশীয় মুক্তা দিয়ে খচিত। মূর্তিটার চেহারা একটা মানুষের মতো। তার কপালে একটা রুবি বসানো; তার চুল থেকে দাবনা পর্যন্ত তেলে ড্যাব ড্যাব করছে। নতুন জবাই করা একটা ছাগল শিশুর রক্ত তার পায়ে।
পাদরিকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম–এই কি দেবতা?
পাদরি বললেন–এই দেবতা।
আমি চিৎকার করে বললাম-আমাকে দেবতা দেখাও। তা না হলে আমি তোমাকে খুন করব। এই বলে আমি তাঁর হাত ধরলাম। সঙ্গে-সঙ্গে তার হাতটা শুকিয়ে গেল।
পাদরি অনুনয় করে বলল–ঈশ্বর তাঁর সেবককে নিযোগ করুন এবং আমি তাকে ঈশ্বর দেখাব।
এই শুনে আমি তাঁর হাতের ওপরে নিঃশ্বাস ফেললাম। তাঁর হাতটা সঙ্গে-সঙ্গে সেরে উঠল। কাঁপতে কাঁপতে তিনি আমাকে দ্বিতীয় কক্ষে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমি আর একটি মূর্তি দেখলাম। সেই মূর্তিটিও বহুমূল্য অলঙ্কারে সুসজ্জিত।
দেবতা কোথায়?–জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
ইনিই দেবতা।
সত্যিকার দেবতা আমাকে দেখাও; না হলে, আমি তোমাকে হত্যা করব। এই বলে আমি তাঁর। চোখ দুটি সপর্শ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্ধ হয়ে গেলেন।
পাদরি আমাকে অনুনয় করে বললেন–ঈশ্বর তাঁর সেবককে নিরোগ করুন, তাহলেই আমি তোমাকে ঈশ্বর দেখাব।
তাঁর চোখের ওপরে নিঃশ্বাস ফেলতেই তিনি আবার তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন।
তিনি আমাকে তৃতীয় প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সেখানে কোনো মূর্তি নেই রয়েছে পাথরের বেদীর ওপরে একটা আয়নামাত্রা
দেবতা কোথায়?–জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
তিনি বললেন–দেবতা বলে কিছু নেই। রয়েছে মাত্র এই আয়না; এটাকে বলা হয় বিজ্ঞতার আয়না। এর মধ্যে থেকে স্বর্গ আর মর্তের প্রতিটি জিনিস প্রতিফলিত হয়। অনেক আয়নাই এখানে রয়েছে; কিন্তু সেগুলি সবই ওই বিভিন্ন মতবাদের আয়না। যাদের এই আয়নাটি রয়েছে তারা সব কিছুই জানতে পারে। সেই জন্যে এটি আমাদের ঈশ্বর। আমরা সবাই একে পুজো করি।
আয়নার দিকে তাকিয়েই বুঝলাম পাদবিটি সত্যি কথাই বলেন। তারপরে আমি একটা অদ্ভুত কাজ করলাম; কিন্তু সে কথা থাক। এখান থেকে একদিনের দূরত্ব একটি জায়গায় আমি সেটিকে লুকিয়ে রেখে এসেছি। আমাকে যদি তোমার ভেতরে ঢুকতে দিয়ে তোমাকে সেবা। করার সুযোগ দাও তাহলে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানী মানুষদের চেয়েও তুমি বেশি বিজ্ঞ হতে পারবো সেই আয়নাটি হবে তোমার সম্পত্তি। সুতরাং তোমার ভেতরে আমাকে প্রবেশ করতে দাও।
কিন্তু যুবক ধীবরটি হেসে বলল–জ্ঞানের চেয়ে প্রেম মহত্তর এবং খুদে জল-অপ্সরী আমাকে ভালোবাসে।
আত্মাটি বলল–না, না-ওকথা বলো না। জ্ঞানের চেয়ে ভালো জিনিস আর কিছু নেই।
ধীবরটি বলল–প্রেম মহত্তর। এই বলে সে ডলে ডুবে গেল। কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেল আত্মা। দ্বিতীয় বছরের শেষে আত্মাটি আবার সেইখানে ফিরে এসে তাকে ডাকল। সমুদ্রের তলা থেকে মুখ তুলে ধীবরটি জিজ্ঞাসা করল–আমাকে ডাকছ কেন?
আত্মাটি বলল–আমার কাছে এস। আমি যে সব অদ্ভুত জিনিস দেখেছি সেসব কাহিনি তোমাকে আমি বলব।
সুতরাং সে অগভীর জলে উঠে এসে কাহিনি শোনার জন্যে হাতের ওপরে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বসল।
আত্মাটি বলে গেল–তোমার কাছ থেকে ফিরে গিয়ে আমি দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলাম। ওই দক্ষিণ দেশ থেকে সমস্ত কিছু মূল্যবান জিনিস দেশ-বিদেশে যায়। যে রাস্তাটা আশতার শহরে দিকে এগিয়ে গিয়েছে আর যার ওপর দিয়ে নানান তীর্থযাত্রী আসা-যাওয়া করে সেই রাস্তা ধরে ছ’দিন আমি হাঁটলাম। সাত দিনের দিন চোখ তুলে দেখলাম উপত্যকার ওপরে একটা শহরের কাছে এসে পৌঁছেছি।
সেই শহরের দরজা নটা। প্রতিটি দরজার সামনে একটা ব্রোঞ্জ-এর ঘোড়া দাঁড়িয়ে। পাহাড়ের ওপর থেকে বেদুইনের দল শহরের দিকে এগিয়ে এলেই তারা চিৎকার করে ওঠে। তামা দিয়ে দেওয়ালগুলি মোড়া; ছাদের ওপরে দস্তা ঢালা। প্রত্যেক গম্বুজের ওপরে একজন করে তীরন্দাজ ধনুক হাতে নিয়ে পাহারা দিচ্ছে।
আমি ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই প্রহরীরা আমাকে বাধা দিল। আমি কে জিজ্ঞাসা করতে আমি বললাম আমি একজন দরবেশ। আমি মক্কায় যাচ্ছি। সেখানে সবুজ কাপড়ে মোড়া কোরান রয়েছে। দেবদূতেরা রুপোর অক্ষরে তার ওপরে নক্সা এঁকেছে। এই শুনে অবাক হয়ে তারা আমাকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিল।
শহরের ভেতরে বাজার। তোমার আমার সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। সর সর রাস্তার ওপরে সেখানে প্রডাপতির মতো খুদে-খুদে কাগজের লণ্ঠন জ্বলছে। দোকানের সামনে সিল্কের কার্পেটের ওপরে বণিকরা বসে রয়েছে। তাদের দডিগুলো কালো সূচলো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভারত মহাসাগর থেকে আমদানি করা সুগন্ধী আতর বিক্রি করে। কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে দাঁড়ালে তারা জ্বলন্ত ধুলোচুরের ওপরে কিছু সুগন্ধ মশলা ঢেলে দিয়ে বাতাসটাকে মাতোয়ারা করে তোলে। বাজারে নানান লোক নানান জিনিস বিক্রি করছে। কেউ বিক্রি করছে রুপোর ব্রেসলেট, কেউ বিক্রি করছে মুক্তাখচিত দস্তার অ্যালকলেট, কেউ বা আবার বিক্রি করছে সোনার পাতের মধ্যে আকা বাঘের থাবা, কেউ চিতাবাঘের থাবা। চাযের দোকানের ভেতর থেকে গিটার বাজানোর শব্দ আসছে; আর আফিওখোরেরা তাদের সাদা। সাদা হাস মুখ নিয়ে পথচারীদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।