সন্ধ্যার দিকে তাতাররা ফিরে এল; কিন্তু তাদের মধ্যে পাঁচজনকে দেখা গেল না। যারা ফিরে। এল তাদের মধ্যেও কম লোক আহত হয়নি। তারা সেই গাড়িগুলোকে ঘোড়ার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল। তিনটে শেয়াল গর্ত থেকে বেরিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে একবার দেখেই উলটো দিকে চলে গেল।
চাঁদ উঠলে দেখলাম সমতলভূমির ওপরে তাঁবুর কাছে আলো জ্বলছে। এই দেখে আমি সেই দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম কার্পেটের ওপরে একদল বণিক বসে রয়েছে। পেছনে বাঁধা। রয়েছে উটের দল; আর তাদের নিগ্রো চাকররা তাদের জন্যে তাঁবু খাঁচাচ্ছে। তাদের কাছে হাজির হতে বণিকদের নেতা তরোযাল খুলে জিজ্ঞাসা করল–কী চাই?
বললাম আমি আমার দেশের একজন রাজপুত্র। তাতাররা আমাকে ধরে এনে ক্রীতদাস করে রাখবে ভেবেছিল, আমি তাদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি।
আমার কথা শুনে লোকটা হেসে আমাকে পাঁচটা কাটা মুণ্ডু দেখাল। মুণ্ডুগুলো পাঁচটা লম্বা। বাঁশের মাথার ওপরে গাঁথা ছিল। লোকটা আমাকে জিজ্ঞাসা করল–ঈশ্বরের অবতার কে? আমি বললাম-মহম্মদ।
এই কথা শুনে মাথাটা নুইয়ে সে হাত ধরে আমাকে তার পাশে বসাল। কাঠের পাত্রে একটা নিগ্রো ক্রীতদাস আমার জন্যে ঘোড়ার দুধ এনে দিল; আর এনে দিল সেদ্ধকরা একটুকরো মেড়ার মাংস।
সকাল হতে আমাদের যাত্রা শুরু হল। দলপতির পাশে-পাশে লাল-চুলো একটা উটের পিঠে চড়ে আমি চলতে লাগলাম। আমাদের সামনে বর্শা নিয়ে ছুটতে লাগল একটা লোক। আমাদের দু’পাশে চলল সৈন্য। পেছনে চলল খচ্চরের দল পণ্য নিয়ে।
তাতারদের দেশ ছেড়ে আমরা আর একটা দেশে হাজির হলাম। সেখানকার লোকেরা চন্দ্রকে অভিসম্পাত দেয়। আমরা গ্রাইফোনসদের দেখলাম। সাদা পাহাড়ের ওপরে বসে তারা। তাদের ধনরত্ন পাহারা দিচ্ছিল। পাচ্ছে নিঃশ্বাসের হাওযার বরফ ঝরে পড়ে এই ভযে পাহাড়ের ওপর দিয়ে আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে হাঁটছিলাম। উপত্যকা দিয়ে যাওয়ার সময় গাছের কোটর থেকে পিগমিরা আমাদের দিকে তীর ছুঁড়ল রাত্রিতে বন্য মানুষেরা ভট্রাক পিটতে লাগল। বাঁদরদের টাওয়ারে এসে আমরা তাদের ফল খেতে দিলাম। ফলে, তারা আমাদের কোনো অনিষ্ট করল না। সাপেদের টাওয়ারে এসে তামার পাত্রে তাদের দুধ খেতে দিলাম। তারা আমাদের পথ ছেড়ে দিল।
প্রতিটি শহরের রাজা আমাদের ওপরে কর বসাল; কিন্তু আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিল না। দেওয়ালের ওপাশ থেকে কিছু বুটি আর অন্যান্য খাবার ছুঁড়ে দিল। গ্রামবাসীরা আমাদের আসতে দেখে পাতকুযযার ডলে বিষ মিশিয়ে দিয়ে সব পাহাড়ের ওপরে পালিয়ে গেল। আমরা ম্যাগভি-দের সঙ্গে লড়াই করলাম। এরা বুড়ো হয়ে জন্মায়। তারপর ছোটো হয়ে ক্রমশ বাড়তে থাকে। শেষকালে মারা যাওয়ার সময় শিশু হয়ে যায়। লড়াই করলাম ল্যাকট্রইদের সঙ্গে। বাঘেদের সন্তান বলে নিজেদের জাহির করে তারা। আমাদের লড়াই করতে হল অরেনটিসদের সঙ্গে। মৃতদেহকে এরা গাছের ওপরে কবর দেয়, নিজেরা থাকে গুহার অন্ধকারে। এই সব লড়াই-এ আমাদের দলের এক তৃতীয়াংশ মারা গেল; আর এক তৃতীয়াংশ মারা গেল অভাবে বাকি যারা রইল তারা আমার বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করত লাগল যে তাদের এই সব দুর্ভাগ্যের জন্যে আমিই দায়ী। পাথরের নীচে থেকে শিং-ওয়ালা একাট বিষাক্ত সাপ বার করে ছোবল খেলাম তার। তারা যখন দেখল সাপের ছোবল খেয়েও আমাদের কিছু হল না তখন তারা ভয় পেয়ে গেল।
চতুর্থ মাসে আমরা হাজির হলাম ইলেল শহরে। তখন রাত্রি, আকাশে ফিকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। গাছ থেকে ডালিম পেড়ে তারই রস খেলাম আমরা। তারপরে আমাদেরই কার্পেট বিছিয়ে সকালের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সকাল হলে শহরের ফটকে ধাক্কা দিলাম আমরা, ফটকের দরজা ছিল লাল ব্রোঞ্জ-এর; তার গায়ে আঁক ছিল সামুদ্রিক আর পাখা-ওয়ালা ড্রাগনদের ছবি। প্রাচীরের ওপর থেকে সশস্ত্র প্রহরীরা জিজ্ঞাসা করল–কী চাই তোমাদের? আমাদের মধ্যে যে দোভাষী ছিল সে বলল–সিরিয়া থেকে আমরা অনেক। পণ্যদ্রব্য নিয়ে এসেছি। আমাদের মধ্যে কয়েকজনকে তারা জামিন রেখে বলল–দুপুরের দিকে দরজা খোলা হবে। তোমরা ওখানে অপেহষ্কা কর।
দুপুরের দিকে দরজা খোলা হল। শহরের ভেতরে আমরা ঢুকে গেলাম। চারপাশ থেকে লোক এসে আমাদের দেখতে লাগল। একজন ঘোষক আমাদের আগমনবার্তা জানিয়ে জানিয়ে এগিয়ে গেল আমরা বাজারে এসে দাঁড়ালাম, আর নিগ্রোরা বাক্সপ্যাটরা খুলে জিনিসপত্র সব দেখাতে লাগল।
প্রথম দিন পাদরি এসে আমাদের সঙ্গে দরকষাকষি করল। দ্বিতীয় দিন এলো অভিজাত
সম্প্রদায়ের লোকেরা তৃতীয় দিনে হাজির হল মিস্ত্রি আর ক্রীতদাসের দল। বিদেশ থেকে বণিকরা এলে এই রীতিতেই ওখানকার মানুষেরা তাদের সঙ্গে সওদা করত।
প্রায় পনেরোটি দিন এইভাবে আমাদের কেটে গেল। তারপরে শুক্লপক্ক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্ত হয় আমি শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরতে ঘুরতে আমি একটা বাগানে এসে হাজির হলাম। সেখানে ওদের দেবতা বাস করেন। বেগুনে পোশাক পরে পাদরীরা সবুজ গাছের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কালো মার্বেল পাথরের একটি জায়গার ওপরে একটা। গোলাপের মতো লাল বাড়ি। সেখানেই দেবতারা থাকে। মণি-মুক্তা দিয়ে খচিত তার দরজা নানা চিত্রে শোভিত তার দেওয়াল। মন্দিরের সামনে পরিষ্কার ঝকঝকে একটি জলাশয়। তার পাশে আমি শুয়ে রইলাম। আমার বিবর্ণ আঙুলগুলি দিয়ে চওড়া-চওড়া পাতাগুলিকে ধরলাম। একটি পাদরি আমার দিকে এগিয়ে এসে পেছনে দাঁড়ালেন। তাঁর পায়ে চটি-জুতো। একটা পাটি জুতো সাপের নরম চামড়া দিয়ে তৈরি, আর এক পাটি জুতো তৈরি পাখির পালক দিয়ে।