ডাইনিটি তাকে ফিসফিস করে বলল–এস আমরা ওঁকে পুজো করি।
হাত ধরে তাকে সে এই লোকটির কাছে নিয়ে গেল; কিন্তু কাছাকাছি আসতেই কী জানি কেন ধীবরটি ক্রুশের ভঙ্গিতে তার বুকের ওপরে হাত দুটো রাখল; আর ঈশ্বরের নাম করল।
যুবকটির এরকম ব্যবহার দেখেই ডাইনিরা বাজপাখির মতো চিৎকার করতে করতে উড়ে পালাল; যে বিবর্ণ মুখটা এতক্ষণ ধরে তাকে লক্ষ করছিল সেটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠতে লাগল, তারপরে সে বনের মধ্যে দৌড়ে গিয়ে ঘোড়ায় চেপে তার দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
লাল চুল-ওয়ালী সেই ডাইনিটিও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল; কিন্তু ধীবরটি শক্ত করে তার কব্জিটা ধরে রইলা সে চিৎকার করে বলল–আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও; কারণ, তুমি এমন একটি শব্দ উচ্চারণ করে যা তোমার উচ্চারণ করা উচিত হয়নি; এমন একটি চিহ্ন দেখিযে যার দিকে তাকানো উচিত নয় আমাদের।
ধীবরটি বলল–ওসব ছাড়া সেই গোপন কথাটা না বলা পর্যন্ত আমি তোমাকে ছেড়ে দেব না।
ডাইনির ঘেসো-সবুজ রঙের চোখ দুটো জলে করুণ হয়ে উঠল; বলল–ওটা বাদ দিয়ে তোমার যা ইচ্ছা তাই চাও।
ধীবরটি হেসে তার মুঠো আরও শক্ত করে ধরে রইল।
তার হাতে থেকে নিস্তার নেই বুঝতে পেরে ডাইনি অনুনয় করে বলল–সমুদ্রের মেয়ের মতোই নিশ্চয় আমি সুন্দরী, আর তারই মতো শান্ত।
কিন্তু ধীবরটি তাকে একটা ঝাঁকনি দিয়ে বলল–হয় বল; না হয়তো তোমাকে আমি খুন করে ফেলুব]
এই কথা শুনে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডাইনি বলল–তবে তাই হোক। তোমার আত্মা তোমার নিজস্ব। আমার নয়। ওকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই তুমি করতে পার।
এই বলে কোমরবন্ধনী থেকে ছোটো একটা ছুরি বার করে সে যুবকটির হাতে দিল।
অবাক হয়ে যুবকটি জিজ্ঞাসা করল–এ দিয়ে আমি কী করব?
একটু চুপ করে রইল ডাইনি; ভয়ার্ত হয়ে উঠল তার দৃষ্টি। তারপরে কপালের উপর থকে। চুলগুলি সরিয়ে দিয়ে অদ্ভুতভাবে হেসে বলল–মানুষ যেটাকে দেহের ছায়া বলে মনে করে। সেটা দেহের ছায়া নয–সেটা হল আত্মার ছায়া। চাঁদের দিকে পেছন করে সমুদ্রের উপকূলে। দাঁড়াও। পায়ের চারপাশে তোমার যে ছায়াটাকে দেখতে পাবে সেটা কেটে ফেলবে। তারপরে তোমার আত্মাকে নির্দেশ দেবে তোমাকে ছেড়ে যেতো তখনই তোমার আত্মা তোমাকে ছেডে চলে যাবে।
সত্যি?
সত্যি তোমাকে এটা হয়তো আমার বলা উচিত হয়নি।
এই বলে কাঁদতে কাঁদতে সে তার হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরল।
ধীবরটি তাকে ঘাসের ওপরে ফেলে রেখে ছুরিটা তার কোমরে বেঁধে পাহাড় থেকে নেমে এল।
এবং তার ভেতরে যে আত্মাটা ছিল সে তাকে ডেকে বলল–শোন। আমি এতদিন তোমার সঙ্গে বাস করেছি–দাসত্ব করেছি তোমার। এখন আমাকে তুমি বিসর্জন দিয়ো না। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।
যুবকটি হেসে বলল–তা তুমি করনি। কিন্তু তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই। বিরাট বিশ্ব–এখানে স্বর্গ আর নরক দুই-ই রয়েছে। যেখানে ইচ্ছে তুমি চলে যাও। আর আমাকে বিরক্ত করো না। কারণ, আমার প্রেয়সী আমাকে ডাকছে।
আত্মা বলল–যদি একান্তই আমাকে বিদায় দাও তাহলে অন্তত হৃদয়টাকেও দাও। এই পৃথিবী বড়োই নিষ্ঠুর। সুতরাং হৃদযটাকেও নিয়ে যেতে দাও আমাকে।
যুবকটি হেসে মাথা নেড়ে বলল–হৃদয়টাই যদি তোমাকে দিলাম তাহলে প্রেয়সীকে আমি কী দেব? ওটা আমার প্রেমিকার। অতএব চলে যাও। আর দেরি করো না।
প্রেমে কি আমারও প্রয়োজন নেই?
চলে যাও, চলে যাও। তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই।
এই বলে ছুরিটা নিয়ে সে পায়ের ছায়াটা কেটে ফেলে ছুরিটা আবার কোমরে গুঁজে রাখল। চলে যাও, চলে যাও। তোমাকে আর আমার প্রয়োজন নেই।
আটি বলল–না, আবার আমাদের দেখা হবে।
যুবকটি জিজ্ঞাসা করল–কী করে? তুমি নিশ্চয় সমুদ্রের তলায় আমার সঙ্গে যাবে না?
বছরে একবার এইখানে এসে আমি তোমাকে ডাকব। হয়তো, আমাকে তোমার প্রয়োজন হতে পারে।
যুবকটি বলল–তোমাকে আমার আবার কী প্রয়োজন হবে বুঝতে পারছি নে, তবে তুমি যখন আসতে চাইছ তখন এস।
এই বলে সে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ট্রিটনরা তাদের শিঙে ফুকল। সেই খুদে ভলঅস্পরীটি সমুদ্রের জলে ভেসে তাকে অভ্যর্থনা জানাল; তার দুটি হাতে যুবকের গলাটা জড়িয়ে ধরে। তার মুখে চুমু খেল।
আর সেই নির্জন সমুদ্রতীরে আত্মাটি নিঃসঙ্গভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখল। যখন তারা জলের তলায় ডুবে গেল তখনই সে কাঁদতে-কাঁদতে জলাভূমির ওপর দিয়ে চলতে লাগল।
এক বছর পরে সেইখানে ফিরে এসে আত্মাটি তাকে ডাকল। সমুদ্র থেকে উঠে যুবকটি জিজ্ঞাসা করল–ডাকছ কেন?
আমার কাছে এস। আমি কী অদ্ভুত জিনিস দেখেছি সেই সব কথাই তোমাকে বলব।
কাছে এস অগভীর জলে হেলান দিয়ে বসে ধীবরটি তার কথা শুনতে লাগল।
আত্মাটি বলল– তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উত্তর দিকে মুখ করে আমি হাঁটতে লাগলাম। বিশ্বের যা কিছু বিজ্ঞতা সবই এই পূর্বদিক থেকে এসেছে। ছ’দিন হাঁটার পরে সপ্তম দিন সকালে আমি একটা পাহাড়ের কাছে এসে হাজির হলাম। এই দেশটা হচ্ছে তাতারদের। রোদের ঝাঁঝ এড়ানোর জন্যে আমি একটা গাছের ছায়ায় বসলাম। শুকনো মাটি, একেবারে রোদে পুড়ে গিয়েছে। মাছির মতো গুঁড়ি দিয়ে মানুষরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে।
দুপুরের সময় দেখলাম সমতলভূমি থেকে লাল ধুলো উঠে আকাশ ছেয়ে দিয়েছে। এই দেখেই তাতাররা তাদের চিত্রিত ধনুক নিয়ে ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে সেইদিকে এগিয়ে গেল। মেয়েরা চিঞ্জার করতে করতে গাড়ির পেছনে নিজেদের লুকিয়ে ফেলল।