যুবক ধীবর বলল–আমি চাই সামান্য; কিন্তু পাদরি রেগে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, আমাকে বিদ্রূপ করেছে ব্যবসাদাররা। যদিও মানুষে তোমাকে ডাইনি বলে, তবু সেই জন্যেই আমি তোমার কাছে এসোচ্ছিা তুমি প্রতিদানে যা চাও তাই আমি দেব।
তার সামনে এগিয়ে এসে ডাইনিটি জিজ্ঞাসা করল–কী চাও বলা
আত্মাটিকে আমি বিদায় দিতে চাই।
ডাইনির মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। কেঁপে উঠল তার শরীর। নীল চাদরে সে তার মুখটা ঢেকে ফেলল। তারপরে বিড়বিড় করে বলল–সুন্দর যুবক, ওটা বড়ো ভয়ানক জিনিস।
যুবকটি তার তামাটে চুলগুলিকে ঝাঁকুনি দিয়ে হেসে বলল–আয়াটা আমার কাছে কিছু নয়। আমি তাকে দেখতেও পাইনে, সপর্শও করতে পারি নে। আমি তাকে চিনিও না।
সুন্দর চোখ দুটি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ডাইনি বলল–যদি তোমাকে আমি বলে দিই তাহলে আমাকে তুমি কী দেবে?
সে বলল–পাঁচটা সোনার মোহর। সেই সঙ্গে দেব ডাল, আমার বাড়ি, আর যে নৌকো ভাসিয়ে আমি মাছ ধরতে যাই সেই লৌকো। শুধু পথটা আমাকে দেখিয়ে দাও; আমার যা কিছু রয়েছে সব তোমাকে দিয়ে দেব।
বিদ্রূপ করে হেসে ডাইনিটি বলল–শরৎকালের পাতাকে আমি সোনায় পরিণত করতে পারি। ইচ্ছে হলে, বিবর্ণ চাঁদের আলোকে আমি রুপোর স্রোতে পরিণত করতে পারি। আমার মনিব বিশ্বের সমস্ত রাজাদের চেয়ে ধনী।
তাহলে, কী চাই তোমার?
আমার সঙ্গে নাচতে হবে।
মাত্র এই? অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল যুবকটি।
ও ছাড়া আর কিছু নয়-এই বলে ডাইনিটি মিষ্টি করে হাসল।
যুবকটি বলল–তাহলে সূর্যাস্তের পরে কোনো গোপন জায়গায় আমরা দুজনে নাচব। নাচের শেষে আমি যা জানতে চাই তুমি আমাকে তাই বলে দেবে।
ডাইনিটি ঘাড় নেড়ে বলল–পূর্ণিমার রাতে, পূর্ণিমার রাতে।
এই কথা বলে চারপাশে একবার উঁকি দিয়ে কান পেতে কী যেন শুনতে লাগল সে। একটা নীল পাখি চিৎকার করতে-করতে তার বাসা থেকে বেরিয়ে উড়ে গেল। মোটা ঘাসের বনে তিনটে। ডোরাকাটা পাখি খস খস করতে করতে শিস দিয়ে পরস্পরকে ডাকতে লাগল। আর শোনা গেল উপলখণ্ডের ওপরে ঢেউ-এর গড়িয়ে পরার শব্দ। এগুলি ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না। কোথাও।
ডাইনিটি ফিসফিস করে বলল–আজ রাত্রিতে পাহাড়ের ওপরে নিশ্চয় তুমি আসবে। আজ হচ্ছে স্যাবাথা। তিনি সেখানে উপস্থিত থাকবেন।
একটু চমকে উঠে সে জিজ্ঞাসা করল–কার কথা বলছ?
ডাইনিটি বলল— শুনে লাভ নেই তোমার, আজ রাত্রিতে যথাস্থলে উপস্থিত হয়ে হর্নবিম গাছের ডালের নীচে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে তুমি যদি কোনো কালো কুকুর তোমার দিকে দৌড়ে আসে তাহলে উইলো গাছের একটা লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করো। তাহলেই সে পালিয়ে যাবে। যদি কোনো পেঁচা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়–তার কথার কোনো উত্তর দিয়ো না। আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠলেই আমি তোমার কাছে আসব। তারপরে আমরা দুজনে ঘাসের ওপরে নাচব।
সে জিজ্ঞাসা করল–কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে তো?
ছাগলের খুরে দিব্যি দিয়ে বলছি, দেব।
যুবকটিই তার মাথা থেকে টুপিটা একটু তুলল; তারপরে মাথাটা একটু নুইয়ে খুশি মনে ফিরে গেল।
যতদূর দেখা যায় ডাইনিটি তাকে দেখল; তারপরে গুহার ভিতরে গিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখল; চারকোল পুড়িয়ে ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে কী যেন দেখল; তারপরে মুষ্টিবদ্ধ করে বলল–জল-অপ্সরীর মতোই আমি সুন্দরী। ও আমারই হওয়া উচিত ছিল।
এবং সেদিন সন্ধ্যায় চাঁদ ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে সে পাহাড়ের ওপরে উঠে হর্নবিম গাছের নীচে অপেক্ষা করতে লাগল। মধ্য রাত্রিতে ডাইনিরা বাদুড়ের মতো উড়তে উড়তে সেখানে হাজির হল। ঘাসের ওপরে নেমে তারা বলাবলি করতে লাগল–এ যে নতুন লোক দেখছি! শেষকালে বাতাসে লাল চুল উডিযে এল সেই যুবতী ডাইনি। তাকে দেখেই অন্য ডাইনিরা চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল–তিনি কোথায়-তিনি?
ডাইনিটি একটু হেসে হর্নবিম গাছের তলায় দৌড়ে গিয়ে ধীবরটির হাতে ধরে ঘাসের ওপরে টেনে নিয়ে এল। তারপরে তারা নাচতে শুরু করল। দুজনে তারা ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। ঠিক এমন সময় মনে হল কে যেন ঘোড়ায় চেপে দ্রুতবেগে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু কোনো ঘোড়াই তার চোখে পড়ল না। কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল সে।
ডাইনি বলল–জোরে, জোরে; আরো জোরে। এই বলে ধীবরটির গলাটা সে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। তার তপ্তশ্বাস যুবকটির গালের ওপরে এসে পড়ল। আরও জোরে, আরও ডোরে’–চিৎকার করে উঠল ডাইনি। মনে হল, পৃথিবীটা তাদের তলায় বনবন করে ঘুরছে।
যুবকটির কেমন যেন ভয় লাগল। তার মনে হল কোনো অমঙ্গল যেন তাকে লক্ষ করছে। তারপরে তার মনে হল পাথরের ছায়ার নীচে একটা লোক বসে রয়েছে। এর আগে তাকে সে। দেখেনি। লোকটার গায়ে কালো ভেলভেটের পোশাক। তার মুখটা অদ্ভুত রকমের বিবর্ণ কিন্তু তার ঠোঁট দুটি লাল ফুলের মতো গর্বিত। তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হল; মনে হল যেন। অন্যমনস্কভাবে একটা ছোরার বাঁট নিয়ে সে খেলা করছে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো যুবক ধীবরটি তাকে লক্ষ করল। তারপরে চারটি চোখের মিলন হল। ডাইনিটির হাসির শব্দ সে শুনতে পেল। সে তার কোমর জড়িয়ে ধরে বনবন করে ঘুরোতে লাগল। বনের ভেতরে হঠাৎ একটা কুকুর ডেকে উঠল। নাচিঘেরা সব থেমে গেল। তারপরে জোড়া-জোড়া তারা সেই লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে তার হাতে চুমু খেল। কিন্তু লোকটির ঠোঁট দুটো ব্যঙ্গের হাসিতে বেঁকে গেল। সে কেবল যুবক ধীবরটির দিকে তাকিয়ে রইল।