গির্জার নতুন কর্মচারীটি বেড়ার ফাঁক থেকে তাকিয়ে দেখল, তারপরে নিশ্চিন্ত হয়ে সে দরজা খুলে দিয়ে বলল—এস। যুবক ধীবরটি ভেতরে ঢুকে গেল; সুগন্ধ নলখাগড়া পাতা ছিল। মেঝেতে। পাদরি তখন প্রভুর গ্রন্থ পাঠ করছিলেন। সেইখানে হাঁটু মুড়ে বসে পাদরিকে। সম্বোধন করে ধীবরটি বলল–পিতা, আমি একটি জলচর প্রাণীর সঙ্গে প্রেমে পড়েছি। কিন্তু তার সঙ্গে মিলনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে আমার এই আত্মা। বলুন দেখি, কেমন করে আমি আমার এই আত্মাটাকে বিদায় করে দিতে পারি। কারণ, সত্যি কথা বলতে কি একে আমার প্রয়োজনটাই বা কী? এর দামই বা আমার কাছে কতটুকু? আমি একে দেখতেও পাই নে, একে স্পর্শও করতে পারি নে। আমি একে চিনিও না।
এই কথা শুনে পাদরিটি বুক চাপড়িয়ে বললেন–হায়, হায়! তুমি কি উন্মাদ হয়েছ, না, কোলো। বিষাক্ত ওষুধ খেয়েছ? আত্মাই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যাতে আমরা খুব ভালো আর। সভাবে ব্যবহার করতে পারি সেই উদ্দেশ্যেই ঈশ্বর এটি আমাদের দিয়েছেন। বিশ্বের সমস্ত সোনা-দানা একসঙ্গে জড়ো করলেও এর সমমূল্যের হয় না। সেই জন্যে বলছি, ওকথা তুমি আর মনেও স্থান দিয়ো না। একথা ভাবাও পাপ; সে-পাপের কোনো ক্ষমা নেই। আর জলচর প্রাণীদের কথা যদি বল তাহলে বলতে হয় তারা সবাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যারা তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে তারাও অধঃপাতে গিয়েছে। তারা হচ্ছে মাটির পশু; ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান তাদের নেই। ঈশ্বর তাদের জন্যে মৃত্যু বরণ করেননি।
পাদরির এবম্বিধ বাক্য শুনে যুবক ধীবরটির চোখ দুটি জলে ভরে উঠল; তারপরে সে দাঁড়িয়ে উঠে বলল–পিতা, বনদেবতারা খুশি মনে বনে বাস করে; গন্ধর্বরা সোনার বীণা নিয়ে পাথরের ওপরে বাসে থাকে। তাদের দিনগুলি ফুলের মতো মিষ্টি। তোমাকে অনুরোধ করছি আমাকে তুমি তাদের মতো করে দাও। যে আত্মা আমার ভালোবাসার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তাকে পুষে রেখে আমার লাভ কী?
ভুরু দুটো কুঁচকে পাদরি চিৎকার করে বললেন–দেহজ ভালোবাসা নোংরা আর ঈশ্বর যে সব পেগান দেবতাদের তাঁর বিশ্বে ঘুরে বেড়াত দেন তারাও কদর্য। অরণ্যবাসী গন্ধর্বরা নিপাত যাক; নিপাত যাক জল-অপ্সরীর দল। রাত্রিতে আমি তাদের গান শুনেছি। তারা আমাকে ভুলিয়ে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যেতে চায়। আমার জানালায় ঠকঠক করে শব্দ করে তারা হাসে। তাদের সেই বিপজ্জনক আনন্দের কাহিনি তারা আমার কানে কানে বলে যায়। তারা আমাকে প্রলুব্ধ করে। আমি যখন প্রার্থনা করি তখন তারা আমাকে ভেংচি কাটে। আমি তোমাকে বলছি স্বর্গ না নরক-কোথাও তাদের কোনো স্থান হবে না; কোথাও তারা ঈশ্বরের স্তব করবে না।
যুবক ধীরের কেঁদে বলল–পিতা, তুমি কী বলছ তা তুমি জান না। আমার জালে এবার আমি একটি রাজকন্যাকে বন্দী করেছি। সকাল বেলার নক্ষত্রের চেয়েও সে সুন্দরী, চাঁদের চেয়েও সাদা তার দেহের রঙ। তারই জন্যে আত্মাকে আমি বিসর্জন দেব; তারই জন্যে স্বর্গকে আমি পরিত্যাগ করব। সুতরাং আমি যা চাচ্ছি তাই আমাকে দাও; আমি শান্তিতে ফিরে যাই।
পাদরি চিৎকার করে বললেন–দূর হও, দূর হও। তোমার প্রণয়িণীকে ঈশ্বর পরিত্যাগ করেছেন। তোমাকেও ঈশ্বর পরিত্যাগ করবেন।
গভীর দুঃখে মাথাটি নিচু করে যুবকটি বাজারের দিকে এগিয়ে গেল।
ব্যবসাদারেরা তাকে আসতে দেখে নিজেদের মধ্যে কী সব আলোচনা করল; তারপরে তার নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞাসা করলকী বিক্রি করবে হে?
সে বলল বিক্রি করব আমার আত্মা। এটাকে নিয়ে আমি বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তোমরা। এটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নাও। কারণ, আমি একে দেখতেও পাই নে, সপর্শও করতে পারি লে; এটা কী তাও আমি জানি নে। এটা আমার কোন কাজে লাগবে?
ব্যবসাদারেরা তাকে ব্যঙ্গ করে বলল–তোমার আত্মা মানুষের কোন কম্নে লাগবে? এক টুকরো রুপোর দামও ওর নেই। তোমার দেহটাকে বিক্রি করে দাও। আমরা তোমাকে ক্রীতদাস করব। কিন্তু আর কথাটি বলো না। ওর কোনো দাম নেই আমাদের কাছে।
যুবক মনে-মনে বলল–কী অদ্ভুত জিনিস! পাদরি বললেন আত্মার দাম বিশ্বের সমস্ত সোনা একসঙ্গে করলে যা হয় তাই। ব্যবসাদাররা বলছে ওর দান কানাকড়িও নয়।
এই বলে সে বাজার ছাড়িয়ে সমুদ্রতীরে গিয়ে দাঁড়াল; তারপরে কী করবে ভাবতে লাগল।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার একটি বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। বন্ধুটি তাকে এক-ডাইনির কথা বলেছিল। উপকূলের ওপরে একটা গুহায় সে বাস করত। আত্মাকে বিসর্জন দেওয়ার জন্যে সে এতই অস্থির হয়ে উঠেছিল যে সেই কথাটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সেইদিকে ছুটল। তার পেছনে-পেছনে ধুলোর ঝড় বইতে লাগল। হাত কুটকুটানি থেকে যুবতী ডাইনিটি বুঝতে পারল সে আসছে। বুঝে, সে একটু হেসে তার লাল চুলগুলিকে এলিয়ে দিলা এইভাবে এলো চুলে সে তার গুহার মুখে এসে দাঁড়ালা তার হাতে ছিল একগোছা ফুটন্ত হেমলক।
ধীবর যুবকটি যখন হাঁপাতে হাঁপাতে খাড়াই সিঁড়ি বেযে তার সামনে এসে নতজানু হয়ে বসল তখন ডাইনিটি চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল–কী চাও তুমি-কী চাও? ঝড়ের সময়ে। ডালে মাছ ধরতে চাও? আমার শরের ছোটো একটা বাঁশি রয়েছে। সেটা বাড়ালেই মুলেটরা ভাসতে-ভাসতে সব উপকুলের ধারে এসে হাজির হয়। কিন্তু তার জন্যে হে সুন্দর যুবক, তোমাকে কিছু দিতে হবে। তোমার কী চাই–তোমার কী চাই? প্রচণ্ড বাত্যায় জাহাজকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চাও যাতে সমস্ত মণিমুক্তা উপকূলে ভেসে আসবে? তাও তুমি পাবে। কিন্তু তার জন্যে কিছু দিতে হবে তোমাকে। আমার কাছে একটা ফুল রয়েছে সেটা এই উপত্যকারই এমন একটা অংশে জন্মায় যেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তার বুকে একটা তারার চিহ্ন রয়েছে। এর রস হচ্ছে দুধের মতো সাদা। তারই একটা ফোঁটা যদি তুমি রানির দাম্ভিক ঠোঁটের ওপরে একবার বুলিযে দিতে পার তাহলে সে তোমার পিছু পিছু সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু তার জন্যে কিছু দিতে হবে তোমাকে। কিছু দিতে হবে। একটা। ব্যাঙকে পিষে আমি কাদা করে দিতে পারি। সেইটাকে গোলাতে পারি একটা মরা লোকের হাত দিয়ে। ঘুমন্ত শত্রুর ওপরে সেটা যদি ছিটিয়ে দাও তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সাপ হয়ে যাবে। তার মা-ই তখন তাকে মেরে ফেলবে। একটা চাকা দিয়ে চাঁদকে আমি স্বর্গ থেকে টেনে আনতে পারি। একটা স্ফটিক পাত্রের মধ্যে দেখাতে পারি মৃত্যুকে। কী চাও বল। তোমাকে আমি তাই দেব। কিন্তু প্রতিদানে কিছু দিতে হবে তোমাকে।