কিন্তু জালে না রয়েছে মাছ, আর না রয়েছে কোনো সামুদ্রিক দৈত্য। রয়েছে ঘুমন্ত খুদে একটি জল-অপ্সরী। তার চুলগুলি ভেডয় সোনার পশমের মতো–এক একটি চুল যেন কাঁচের গ্লাসে রাখা সোনার সুতো। তার দেহটা হাতির দাঁতের মতো সাদা; তার ন্যাজটা রুপো আর মুক্তো। দিয়ে তৈরি। সমুদ্রের সবুজ আগাছাগুলি তার দেহটিকে বেষ্টন করে রয়েছে। তার কান দুটি সামুদ্রিক ঝিনুকের মতো; প্রবালের মতো রাঙা তার দুটি ঠোঁটা শীতল ঢেউগুলি তার নিরুত্তাপ কুচযুগলের ওপরে গড়িয়ে পড়ছে, তার চোখের পাতায় নুন পড়ে চিকচিক করছে। অপ্সরীটি এত সুন্দরী যে যুবক জেলেটি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। হাত দুটো বাড়িয়ে ভালটাকে সে তার কাছে টেলে নিল; তারপরে ঝুঁকে পড়ে দু’হাতে জাপটে ধরল। তাকে। তাকে সপর্শ করতেই সি-গালের মতো সে চমকে উঠে চিৎকার করে জেগে উঠল। তারপরে ফিকে লাল পদ্মরাগ মণির মতো চোখ দিয়ে ভ্যার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার। দিকে। পালিয়ে যাওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করল সে; কিন্তু ছেলেটি কিছুতেই তাকে ছেড়ে দিল না। জোর করে জাপটে ধরে রাখল।
ছেলেটির আলিঙ্গণ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো আশা নেই বুঝতে পেরে অপ্তরীটি কাঁদতে কাঁদতে বলল–দোহাই তোমার আমাকে ছেড়ে দাও; কারণ নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ রাজার আমিই একমাত্র সন্তান।
কিন্তু ছেলেটি বলল–একটিমাত্র শর্তে তোমাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি। সেটি হচ্ছে এই যে
যখনই আমি তোমাকে ডাকব তখনই তোমাকে আমার কাছে এসে গান গাইতে হবে। সেই গান শুনে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ এসে হাজির হবে। তাহলেই আমার ডাল মাছে বোঝাই হয়ে। যাবে।
অপ্সরীটি কাঁদতে কাঁদতে বলল–আমি যদি তোমার কথামতো কাজ করব বলে প্রতিজ্ঞা করি তাহলেই কি তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে?
নিশ্চয় ছেড়ে দেব।
জল-অপ্সরীটি প্রতিজ্ঞা করতেই সে তার বাহুবন্ধন শিথিল করল। একটা অদ্ভুত ভয়ে কাঁপতে। কাঁপতে অঙ্গরীটি জলের মধ্যে ডুবে গেল।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় যুবকটি সমুদ্রের বুকে গিয়ে অপ্সরীকে ডাকত, আর অগ্ধরীটি ভাল থেকে উঠে এসে তাকে গান শোনাত। সেই গান শুনে শুশুকের দল তার চারপাশে ভেসে বেড়াত। আর বন্য সি-গালের দল তার মাথার ওপরে চক্রাকারে বেড়াত উড়ে। কারণ তার গানগুলি বড়ো সুন্দর। এক গুহা থেকে আর এক গুহায় যারা মেষ চরিয়ে বেড়ায় সেই সব উপকুলবর্তী যাযাবরদের গান সে গাইত; লম্বা সবুজ দাড়িওয়ালা লোমশব ট্রিটনদের গান সে গাইত, সবুজ পাথর দিয়ে তৈরি রাজপ্রাসাদ, যার ছাদ হচ্ছে লাল পাথরের-তার গান সে গাইত। সে গান গাইত সমুদ্রের বাগানের–যেখানে সারাদিন প্রবালের ঢেউ খেলা করে, রুপালি পাখির মতো মাছেরা দৌড়ে বেড়ায় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত–যার পাহাড়ের গায়ে এক ধরনের। সাদা ফুল ফুটে থাকে-হলদে বালির আলে যেখানে ফুটে থাকে পিঙ্ক ফুল। যে সব তিমিরা উওর সমুদ্র থেকে ভেসে আসে তাদের গান গাইত–যাদের গান না শোনার জন্যে নাবিকরা নিজেদের কানের বিবর মোম দিয়ে বন্ধ করে রাখত–কারণ তাদের গান একবার কালে ঢুকলেই সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হত–সেই সব সাইরেনদের গান সে গাইত। তাছাড়া গাইত বিরাট বিরাট জাহাজের গাল, মারম্যানদের গান, যারা সাদা ফেলার বিছানায় শুয়ে থাকে আর নাবিকদের অভ্যর্থনা করার জন্যে নিজেদের হাত বাড়িয়ে দেয়-সেই সব জল-অপ্সরীদের গান সে গাইতা এই গান শুনে মাছের ঝাঁক দৌড়ে আসত সেইখানে। আর জেলের ছেলেটি জাল বোঝাই করে মাছ ধরত। মাছ ধরা শেষ হলে অপ্সরী আবার সমুদ্রে ডুবে যেত।
কিন্তু তবু যুবকটি তার দেহ সস্পর্শ করতে পারে এতটা কাছে কোনোদিনই সে আসত না। যুবকটি অনুনয়-বিনয় করলেও না। ধরার চেষ্টা করলেই সীল মাছের মতো সে জলের তলায় ডুবে যেত, আর সেদিন উঠত না। কিন্তু সে তাকে নিত্য গান শোনাত। সে-গানে যুবকটি মুগ্ধ হয়ে যেত। অনেকদিন মাছ ধরতেও সে ভুলে যেত।
একদিন সন্ধ্যার সময় যুবকটি তাকে বলল–অপ্সরী, জল-অপ্সরী; তোমাকে আমি ভালোবাসি আমাকে বিয়ে কর তুমি।
কিন্তু জল-অপ্সরী মাথা নেড়ে বলল–তা হয় না। তোমার আত্মা হচ্ছে মানুষের। যদি তুমি তোমার ওই আত্মাটিকে সরিয়ে দিতে পার তাহলেই আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারি।
এই শুনে যুবকটি নিজের মনে-মনেই বলল–আত্মাটা আমার কী কাজে লাগছে! আমি ওকে দেখতেও পাই নে, ছুতেও পারি নে। সুতরাং আমি ওকে পরিত্যাগ করব। তাহলেই আমার জীবন আনন্দে ভরে উঠবে।
এই রকম চিন্তা করার সঙ্গে-সঙ্গে আনন্দে তার বুকটা ভরে উঠল; সে হাতটা বাড়িয়ে। বলল–আত্মাকে আমি পরিত্যাগ করব। তুমি হবে আমার বৌ, আমি তোমার বর। তারপরে সমুদ্রের অতলে আমরা দুজনে বাসা বাঁধবো। তুমি যা বলবে তাই আমি করব তাহলে আর আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে না।
খুশি হয়ে জল-অপ্সরী নিজের হাতের মধ্যে মুখটা ঢেকে ফেলল।
যুবকটি চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল–কিন্তু আত্মাটাকে আমি বিদায় দেব কেমন করে? বলে দাও–আমি তাই করব।
অপ্সরীটি বলল–তা আমি জানি নে। সমুদ্রে যারা বাস করে তাদের কোনো আত্মা নেই।
এই বলে তার দিকে একবার সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে সে জলের মধ্যে ডুবে গেল।
পরের দিন খুব সকালে–সূর্য তখনো পাহাড় উঁচিয়ে খুব বেশিদূর একটা ওঠেনি, ধীবর যুবকটি পাদরির বাড়িতে হাভির হয়ে দরজায় ধাক্কা দিল।