আবার সেই কুষ্ঠরোগী তার রাস্তার ওপরে গিয়ে দাঁড়াল, বলল–আমাকে ওটা দাও না হলে আমি খিদেয় মারা যাব।
দেবকুমার বলল–তোমার প্রয়োজন আমার চেয়ে বেশি। সুতরাং তুমিই এটা নাও।
সোনাটুকু সে দিয়ে দিল বটে, কিন্তু তার মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। তার কপালে যে কী রয়েছে তা সে জানত।
কিন্তু কী আশ্চর্য! শহরের ফটকের পাশ দিয়ে সে যখন এগিয়ে যেতে লাগল তখন সেপাই-সান্ত্রীর দল মাথা নীচু করে তাকে সম্মান জানাল, চেঁচিয়ে বলল–আমাদের প্রভু কী সুন্দর দেখতে! শহরবাসীরা তার পিছু-পিছু হাঁটতে-হাঁটতে বলতে লাগল–সত্যিই এত সুন্দর মানুষ পৃথিবীতে আর নেই।
দেবকুমার কাঁদতে কাঁদতে ভাবল-নিশ্চয় ওরা আমার ঠাট্টা করছে। তাকে দেখার জন্যে এত লোকের ভিড় হল যে সে পথ হারিয়ে রাজপ্রাসাদের সামনে এসে হাজির হল। রাজপ্রাসাদের রক্ষীরা দরজা খুলে দিল। পুরোহিত আর উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা দৌড়ে এলেন তার দেখা করার জন্যে, বললেন–আপনিই আমাদের প্রভু। আপনার জন্যেই আমরা অপেক্ষা করে রয়েছি। আপনিই আমাদের রাজার কুমার।
দেবকুমার বলল–আমি কোনো রাজার কুমার নই। আমি হচ্ছি ভিখারিণীর ছেলে। আমি দেখতে কুৎসিত। আপনারা আমাকে সুন্দর বলছেন কেন?
এই শুনে সেই লোকটা যার বর্মের ওপরে সোনার ফুল আঁকা ছিল, আর শিরস্ত্রাণের উপরে ছিল শায়িত সিংহের ছবি–-তার ঢালটাকে দেবকুমারের মুখের সামনে তুলে ধরে বলল–প্রভু যে সুন্দর নন সেকথা কেমন করে তিনি বললেন?
দেবকুমার সেই ঢালের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে অবাক হয়ে গেল; সত্যিই তো! তার সৌন্দর্য ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে তার লাবণ্য আর সুষমা।
রাজপুরুষেরা বলল–পুরাকালের ভবিষ্যৎবাণী হচ্ছে আজকের দিনে আমাদের রাজা ফিরে আসবেন। তিনিই আমাদের দেশ শাসন করবেন। অতএব আপনি এই রাজদণ্ড আর মুকুট গ্রহণ করুন। ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে শাসন করুন আমাদের দেশ।
কিন্তু সে তাদের বলল–না, না। আমি এসবের যোগ্য নই। যে মা আমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন আমি তাঁকে অস্বীকার করেছি। যতদিন না তাঁকে আমি খুঁজে পাচ্ছি, যতদিন না তিনি আমাকে ক্ষমা করছেন ততদিন পর্যন্ত আমার বিশ্রাম নেই। সুতরাং আমাকে যেতে দিন। ওই রাজদণ্ড আর মুকুট দিলেও আমি এখানে থাকতে পারব না।
এই কথা বলে সে রাস্তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এই রাস্তাটাই সোজা শহর-ফটকের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! সেই রাস্তা দিয়ে সেই ভিখারিণীটি তার দিকে এগিয়ে এলেন; আর তাঁরই পাশে সেই কুষ্ঠরোগী।
আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করতে-করতে সে দৌড়ে গেল তাঁর কাছে; মায়ের ক্ষতকে চুম্বন করে চোখের জলে ভিজিয়ে দিল তাঁর পা দুটি। ধুলোর মধ্যে মাথাটা রেখে বলল–মা, দম্ভে একদিন তোমাকে আমি অগ্রাহ্য করেছিলাম। সে-দম্ভ আজ আমার নেই। এখন আমাকে তুমি ক্ষমা কর।
সেই ভিখারিণী কোনো উত্তর দিল না।
সে তখন সেই কুষ্ঠরোগীর সাদা পা দুটো দু’ হাতে জড়িয়ে ধরে বলল–তিনবার তোমাকে আমি দয়া করেছি। আমার সঙ্গে কথা বলতে তুমি নির্দেশ দাও মাকে।
কিন্তু কুষ্ঠরোগীটি একটিও কথাও বলল না।
আবার সে কাঁদতে লাগল–মা, এ দুঃখ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা কর। আবার আমি বনে ফিরে যাই।
এবার সেই ভিখারিণীটি তার মাথার ওপর হাত রেখে বললেন—ওঠ।
সেই কুষ্ঠরোগীটিও তার মাথার ওপরে হাত রেখে বললেন—ওঠ।
সে উঠল। কিন্তু কী আশ্চর্য! তাঁরাই হচ্ছেন রাজা এবং রানি। রানি বললেন–ইনিই তোমার পিতা। এঁকেই তুমি সাহায্য করেছিলে।
রাজা বললেন–ইনিই তোমার মা। এঁরই পা দুটি তুমি চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়েছিলে।
তাঁরা তাকে কাছে টেনে নিয়ে চুমু খেলেন। রাজপ্রাসাদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে রাজপোশাক পরালেন। হাতে দিলেন রাজদণ্ড; মাথায় দিলেন রাজমুকুট। ন্যায়পরায়ণতা আর সততার সঙ্গে রাজত্ব করতে লাগল সে। সেই দুষ্ট যাদুকরকে নির্বাসিত করল। সেই কাঠুরে, তার স্ত্রী আর তাদের ছেলেমেয়েদের উপঢৌকন পাঠাল প্রচুর। পশু-পাখি-মানুষ কারও ওপরে যাতে কেউ নির্দয ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে সজাগ রইল। দেশের মধ্যে সুখ-শান্তি আর ঐশ্বর্য উথলে পড়ল।
কিন্তু জীবনে সে এত কষ্ট পেয়েছিল যে বেশি দিন সে বাঁচল না। তিন বছর পরেই সে মারা গেল। তারপর যে রাজা হল সে বেশ নির্দয়ভাবেই রাজ্য শাসন করতে লাগল।
ধীবর আর তার আত্মা
The Fisherman and his soul
প্রতিদিন সন্ধ্যায় যুবক ধীবরটি সমুদ্রে বেরিয়ে গিয়ে ভাল, ফেলত। উপকূলভাগ থেকে বাতাস বইলে তার জালে কোনো মাছই পড়ত না পড়লেও, তা সামান্য। কারণ সে-বাতাস ঠাণ্ডা, ঝড়ো। ঢেউগুলো ফুলে ফেঁপে সেই বাতাসের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু সমুদ্র থেকে উপকূলের দিকে যখন বাতাস বইত তখনই মাছের দল ঝাঁক বেঁধে দূর-দূরান্ত থেকে এসে তার ভালের মধ্যে ঢুকত। সেই সব মাছ বাজারে নিয়ে গিয়ে সে বিক্রি করত।
প্রতিদিন সন্ধ্যার সময়েই একভাবে সে সমুদ্রে ভাসত; একদিন জালটা এত ভারী হয়ে উঠল যে সে কিছুতেই সেটাকে টেনে নৌকোর ওপরে তুলতে পারল না। নিজের মনে হেসে সে বলল–নিশ্চয় ডালে অনেক মাছ পড়েছে। অথবা, কোনো সামুদ্রিক দৈত্য ধরা পড়েছে যাকে দেখে মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, বা, এমন কোনো বীভৎস ভয়ঙ্কর প্রাণী ধরা পড়েছে যাকে আমাদের মহিমমযী মহারানি পেলে খুশি হবেন। এই বলে সে প্রাণপণ শক্তিতে জালে টান দিলা ধীরে ধীরে জলের ফতনাগুলে ভেসে উঠল; তারও বেশ কিছু পরে ভালটা নৌকোর ধারে উঠে এল।