সেই দেবকুমার শহরের ফটকের কাছে এল, তারপরে যাদুকর যে-বনটার কথা তাকে বলেছিল সেই বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
বাইরে থেকে দেখতে বনটি বড়ো সুন্দর ছিল। কত পাখি গান করছিল সেখালে, কত সুগন্ধী ফুলের সমারোহ জেগেছিল চারপাশে। কিন্তু এত সৌন্দর্যও কোনো কাজে এল না তার। কারণ যে-পথ দিয়েই সে হাঁটতে লাগল সেই পথেই রাশি রাশি কাঁটা গাছ তাকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। তাছাড়া সেই সোনার তালটারও কোনো হদিস পেল না সে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সন্ধেবেলা ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে সে বাড়ির দিকে ফিরল। সেদিন তার কপালে কী আছে তা সে জানত।
যখন সে বনের ধারে এসে পৌঁছেছে এমন সময় পেছনে ঝোপের ভেতর থেকে কে যেন যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। নিজের দুঃখ ভুলে গিয়ে সে দৌড়ে গেল সেইদিকে, দেখল একটা খরগোস ব্যাধের জালে আটকা পড়ে চিৎকার করছে।
তার দয়া হল খরগোসটার উপরে। সে তাকে জাল থেকে মুক্ত করে বলল–আমি একজন ক্রীতদাস ছাড়া আর কিছু নই। তবু তোমাকে আমি মুক্ত করে দিলাম।
তখন খরগোস বলল–সেকথা নিশ্চয় সত্যি। প্রতিদানে তোমাকে আমি কী দেব?
দেবকুমার বলল–আমি একটা সাদা সোনার তাল খুঁজছি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি নে। ওটা নিয়ে না গেলে আমার মনিব আমাকে খুব মারবে।
খরগোস বলল–আমার সঙ্গে এস। আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। সেটা কোথায় আর কী উদ্দেশ্যে রয়েছে তা আমি জানি।
সুতরাং দেবকুমার খরগোসের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেল। সত্যিই তো! বিরাট একটা ওক গাছের কোটরে সাদা সোনার একটা ছোটো তাল রয়েছে। সেইটাকে সে খুঁজতে এসেছিল। আনন্দে আত্মহারা সেই সোনার তালটাকে নিয়ে সে খরগোশকে বলল–তোমার যে উপকার আমি করেছি তার অনেক অনেক বেশি উপকার তুমি আমার করলে। যে দয়া তোমাকে আমি দেখিয়েছি, তুমি তার শতগুণ বেশি দয়া আমাকে দেখালে।
খরগোস বলল–উঁহু! তুমি আমার সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করেছ আমিও তোমার সঙ্গে ঠিক সেই রকম ব্যবহার করেছি।–এই বলে সে দৌড়ে পালিয়ে গেল। দেবকুমারও এগিয়ে গেল শহরের দিকে।
শহরের ফটকের কাছে একটা কুষ্ঠরোগী বসেছিল। ধূসর রঙের একটুকরো কাপড়ের ফালি দিয়ে তার মাথাটা ঢাকা ছিল। সেই কাপড়ের ফুটো দিয়ে তার চোখ দুটো জ্বলছিল জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। তাকে আসতে দেখে সেই লোকটা কাঠের পাত্রের ওপরে শব্দ করে বলল–আমাকে কিছু অর্থ দাও। না খেয়ে আমি মারা যাচ্ছি। ওরা আমাকে শহরের বাইরে বার করে দিয়েছে। এমন কেউ নেই যে আমাকে একটু দয়া করে।
দেবকুমার বলল–হায়, হায়! আমার কাছে একটুকরো সোনা রয়েছে বটে, কিন্তু সেটা যদি আমার মনিবের কাছে নিয়ে না যাই তাহলে সে আমাকে খুব মারবে; কারণ, আমি তার ক্রীতদাস।
কিন্তু কুষ্ঠরোগীরটা তাকে সেটা দেওয়ার জন্যে বড়োই অনুরোধ করতে লাগল। শেষকালে সে তার সেই সোনার টুকরোটা না দিয়ে পারল না।
যাদুকর তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল–তুমি সেই সাদা সোনার তালটা নিয়ে এসেছ?
দেবকুমার বলল–না।
এই শুনে ঘাদুকর তাকে বেদম প্রহার করতে লাগল। তারপরে একটা শূন্য খাবার থালা আর শূন্য কাপ তার সামনে রেখে বলল–খাও।
পরের দিন সকালে সেই যাদুকর এসে বলল–আজ যদি তুমি সেই হলদে সোনার টুকরোটা না আনতে পার তাহলে তোমাকে আমি চিরকাল আমার চাকর করে রাখব; আর চাবুক খাবে তিনশটি।
দেবকুমার আবার সেই বনে ফিরে গেল; সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত হলদে সোনার খোঁজে বৃথাই সে খুঁজে বেড়াল। সূর্যাস্তের সময় একটা পাথরের ওপরে বসে সে যখন কাঁদছে এমন সময় সেই বাচ্চা খরগোসটা তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল–কাঁদছ কেন? কী হয়েছে তোমার?
সে বলল–আমি খুঁজছি হলদে সোলার তাল। এইখানেই কোথাও সেটা লুকালো রয়েছে। সেটা নিয়ে না গেলে আমার মনিব আমাকে খুব মারবে। আমি তার কেনা চাকর কি না।
খরগোস বলল–আমার সঙ্গে এস। এই বলে দৌড়তে-দৌড়তে সে একটা জলাশয়ের ধারে এসে পৌঁছল। সেই জলাশয়ের তলায় হলদে সোনার তালটা ছিল।
দেবকুমার বলল–তোমাকে আমি কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি নে। এই দ্বিতীয়বার তুমি আমাকে বাঁচালে।
খরগোস বলল–ও কথা বলো না। তুমিই তো আমাকে প্রথম দয়া করেছিলো-এই বলে সে ছুটে পালিয়ে গেল।
ফটকের কাছে আবার সেই কুষ্ঠরোগীটার সঙ্গে দেখা। তাকে দেখেই সে দৌড়ে তার কাছে এগিয়ে এসে কাতর স্বরে ভিক্ষে চাইল। তার অনুরোধ এড়াতে না পেরে দেবকুমার তাকে সেই হলদে সোনার টুকরোটা দিয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে এল।
শূন্য হাতে ফিরে এসেছে দেখে যাদুকর তাকে বিষম প্রহার করল, তারপরে শেকল দিয়ে তাকে বেশ ভালো করে বেঁধে সেই গর্তের মধ্যে ফেলে রেখে চলে গেল।
পরের দিন যাদুকর আবার এল; বলল–আজ যদি তুমি সেই লাল সোনার তালটা নিয়ে আস তাহলে তোমাকে আমি মুক্তি দেব; যদি না আন, তাহলে তোমাকে নির্ঘাৎ খুন করে ফেলব।
আবার সে সেই বনের মধ্যে গেল। আবার সারাদিন বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াল। আবার সন্ধের সময় একটা পাথরের ওপরে বসে কাঁদতে লাগল। তারপরে এল সেই বাচ্চা খরগোস। সব শুনে সে বলল–তোমার পেছনে যে গুহা রয়েছে তারই মধ্যে তো সেটা রয়েছে।
লাল সোনার তালটা নিয়ে সে বলল–বারবার তিনবার আমাকে তুমি বাঁচালে।
খরগোস বলল–উহু! তুমি আমাকে প্রথমে বাঁচিয়েছিলে যে!–এই বলেই সে ছুটে পালিয়ে গেল।