সকাল হল। গাছ থেকে কিছু তেতো ফল তুলে সে চিবোল তারপরে ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে সে আবার বিরাট বনের ভেতর দিয়ে ছুটতে শুরু করল।
একটা ছুঁচোকে সে জিজ্ঞাসা করল–তুমি তো মাটির নীচে যেতে পার। আমার মা সেখানে আছে কি না বলতে পার?
ছুঁচো বলল–তুমি আমার চোখ দুটোকে অন্ধ করে দিয়েছ। আমি জানব কেমন করে?
লিনেট পাখিকে সে জিজ্ঞাসা করল–তুমি লম্বা গাছের ওপর দিয়ে উড়ে গোটা পৃথিবীকে দেখতে পাও। আমার মাকে তুমি দেখেছ?
লিনেট বলল–আমার ডানা দুটো কেটে তুমি আনন্দ করেছ। আমি উড়বো কেমন করে?
ফার গাছের কোটরে নিঃসঙ্গভাবে যে বাচ্চা কাঠবিড়ালি থাকত তাকে সে জিজ্ঞাসা করল–আমার মা কোথায়?
কাঠবিড়ালি উত্তর দিল-আমার মাকে তুমি মেরে ফেলেছ। তোমার মাকেও কি মারতে চাও?
এই কথা শুনে লজ্জায় মাথা নীচু করে দেবকুমার কাঁদতে লাগল; ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রাণীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল; তারপরে সেই ভিখারিণীকে খুঁজে বার করার জন্যে বনের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল। তৃতীয় দিনের বনের শেষ প্রান্তে সে এসে পৌঁছল; তারপরে নেমে গেল সমতলভূমিতে। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে চলার সময় ছেলেমেয়েরা তাকে বিদ্রূপ করতে লাগল–তার দিকে ঢিল ছুঁড়তে লাগল। কেউ তাকে মাঠে-ঘাটে রাত্রে শুতে দিল না। এমন কুৎসিত তার চেহারা হয়েছিল যে কেউ তার ওপরে একটু করুণাও দেখাল না। তিনটি বছর এইভাবে সে তার ভিখারিণী মায়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াল। কোথাও তাকে খুঁজে পেল না। মাঝে-মাঝে তার মনে হত তার মা সামনে এগিয়ে চলেছে। এই দেখে সে তার পিছু পিছু দৌড়ে যেত; কিন্তু পথের ওপরে শক্ত পাথর লেগে তার পা যেত ছিড়ে। কিন্তু সে তাকে ধরতে পারত না। পাশাপাশি যারা থাকত তারা অবশ্য স্বীকার করত যে ওই রকম একটি ভিখারিণীকে তারা দেখেছে কিন্তু কোথায় সেই ভিখারিণী? দুঃখে ভেঙে পড়ত সে।
একদিন একটি নদীর ধারে এক শহরের ফটকের কাছে এসে সে দাঁড়াল। শহরের চারপাশটা শক্ত দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। ক্লান্ত আর পায়ে ঘা হওয়া সত্ত্বেও সে শহরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল। কিন্তু পাহারাদার সৈন্যরা তাদের তরোয়াল উঁচিয়ে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞাসা করল–শহরে তোমার কী দরকার?
সে বলল–আমার মাকে খুঁজছি। সে সম্ভবত এইখানে আছে। দয়া করে আমাকে ঢুকতে দিন।
কিন্তু তারা তাকে বিদ্রূপ করল। একজন তার কালো দাড়ি নেড়ে বলল–সত্যি কথা বলতে কি যা তোমার চেহারা না–কটকটে ব্যাঙ আর সাপও তোমাকে দেখে ভিরমি যাবে। ভাগো-ভাগো। তোমার মা এখানে নেই।
আর একজন জিজ্ঞাসা করল–তোমার মা কে?
সে বলল–আমারই মতো একজন ভিক্ষুক। আমি তার সঙ্গে বড়োই দুর্ব্যবহার করেছি। দয়া করে আমাকে ভেতরে যেতে দাও। তার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে আমাকে।
তারা তো তাকে যেতে দিলই না, অধিকন্তু তাদের বর্শা দিয়ে তাকে খোঁচা দিল।
সে কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছিল এমন সময় বর্ম-পরা একটি বীরপুরুষ তাদের সামনে এসে হাজির হল। তার বর্মের ওপরে সোনার ফুল বসানো, আর শিরস্ত্রাণের ওপরে আঁকা শায়িত সিংহের একটি ছবি। সে এসে তাদের জিজ্ঞাসা করল–কে ভেতরে যেতে চাইছিল?
তারা বলল–ও একটা ভিখিরি। ওকে আমরা তাড়িয়ে দিয়েছি।
সে হেসে বলল–উহু। ওকে আমরা এক ভাঁড় মিষ্টি মদের দামে ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দেব।
একটা কুৎসিত বীভৎস চেহারার লোক সেই সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। এই কথা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বলল–ওই দামে আমি ছেলেটাকে কিনব। এই বলে মদের দাম দিয়ে তাকে সে কিনে হাত ধরে শহরের ভেতরে ঢুকে গেল। শহরের অনেক রাস্তা পেরিয়ে তারা একটা ছোটো দরজার কাছে এসে থামল। একটা দেওয়ালের গায়ে দরজাটা বসানো ছিল। দেওয়ালটাকে ঢাকা দিয়ে রেখেছিল একটা ডালিম গাছ। বুড়ো লোকটা দরজা খুলল। তারপরে দুজনে ব্রাশের তৈরি পাঁচটা সিড়িঁ পেরিয়ে একটা বাগানে এসে হাজির হল। আফিং গাছে আর পোড়া মাটির সবুজ জার-এ বোঝাই ছিল বাগানটা। সেই বুড়োটা তার পাগড়ির ভেতর থেকে একটা সিল্কের রুমাল বার করে তার চোখ দুটো বেঁধে দিল; তারপরে, তার চোখ দুটো বেঁধে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলল। রুমালটা সরিয়ে নেওয়ার পরে সে দেখল একটা গুহার মতো ভাযায় সে এসে পড়েছে। সেখানে শিঙের একটা লন্ঠন জ্বলছে।
তখন বুড়ো লোকটা একটি পাত্রে ছাতাপড়া একটুকরো রুটি তার সামনে ধরে বলল–খাও; আর একটা কাপে কালো একটু জল দিয়ে বলল–পান কর। খাওয়া শেষ হওয়ার পরে বুড়ো লোকটা তাকে লোহার চেন দিয়ে বাঁধল; তারপরে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
ওই বুড়োটা ছিল লিবিয়ার একটু চতুরতম যাদুকর। যার কাছ থেকে সে যাদুবিদ্যা শিখেছিল সেই লোকটা থাকত নীল নদের ধারে একটা কবরখানার ভেতরে। পরের দিন সকালে সেই যাদুকর এল, মুখ বাঁকিয়ে বলল–এই শহরের ফটকের কাছাকাছি একটা বন রয়েছে সেই বনে তিল তাল সোনা রয়েছে। একটা সাদা, একটা হলদে, আর একটা লাল। আজ তুমি সেই সাদা সোনার তালটা নিয়ে আসবে। আনতে না পারলে, তোমাকে একশোবার চাবুক মারা হবে। তাড়াতাড়ি যাও। সন্ধের সময় এইখানে তোমার জন্যে আমি অপেক্ষা করব।
এই বলে তার চোখে সেই সিল্কের রুমালটা বেঁধে ঘর পেরিয়ে বাগানের ভেতর দিয়ে দরজার বাইরে নিয়ে এসে চোখ খুলে দিয়ে বলল–যাও।