এই বলে দলবল নিয়ে সে সেই মেয়েটির দিকে পাথর ছুঁড়তে শুরু করল; বিদ্রূপ করতে লাগল তাকে। মেয়েটি সরে গেল না; একটা ভয়ার্ত বিমূঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কাঠুরে পাশেই কাঠ চিরছিল। এই দেখে সে দৌড়ে এসে তাকে বকতে লাগল-কী নিষ্ঠুর তুমি? দয়ামায়ার বাষ্পও তোমার মধ্যে নেই। এই মেয়েটি তো তোমার কোনো ক্ষতি করেনি।
এই শুনে দেবকুমার রেগে মাটিতে পা ঠুকে বলল–আমার কাজের কৈফিয়ৎ চাওযার কী অধিকার তোমার রয়েছে শুনি? আমি তোমার ছেলে নই যে তোমার হুকুম মানব।
কাঠুরে বলল–সেকথা সত্যি। কিন্তু তোমাকে যখন বনের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম তখন তোমাকে আমিই দয়া করেছিলাম।
সেই মেয়েটি এই কথা শুনেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছিত হয়ে পড়ল। কাঠুরে তাকে নিজের ঘরে বয়ে নিয়ে গিয়ে সেবাযত্ন করল। মূৰ্ছা ভাঙার পরে সে উঠে বসল; তখন মাংস, দুধ আর খাবার দিয়ে কাঠুরে আর তার স্ত্রী তার সেবা-যত্ন করল।
কিন্তু সে কিছুই খেল না; কাঠুরেকে জিজ্ঞাসা করল–তুমি বলছিলে না যে শিশুটিকে তুমি বনের মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছ? আর সেটা কি আজ থেকে বছর দশেক আগে নয়?
কাঠুরেটি উত্তর দিল-হ্যাঁ। বনের মধ্যেই ওকে আমি কুড়িয়ে পেরেছিলাম। আর সেও প্রায় দশ বছর আগেই।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল–ওর দেহে কী কী চিহ্ন ছিল? ওর গলায় কি হলদে রঙের একটা হার ছিল না? ওর গায়ে কি সোনা দিয়ে মোড়া আর তারকা চিহ্ন দিয়ে খচিত একটা আলখাল্লা ছিল না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক-ঠিক। যা বললে ঠিক তাই।
এই বলে সে সিন্দুক থেকে বার করে এনে সেগুলি তাকে দেখাল।
সেইগুলি দেখে মেয়েটি আনন্দে কাঁদতে লাগল। বলল, ওই আমার সেই শিশু। ওকেই আমি বনের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমাকে অনুরোধ করছি ওকে এখনই ডেকে পাঠাও। ওরই জন্যে আজ আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছি।
সুতরাং কাঠুরে আর তার স্ত্রী সেই দেবকুমারকে ডেকে নিয়ে এসে বলল–ঘরে যাও। সেখানে তোমার মা বসে রয়েছেন দেখতে পাবে।
এই কথা শুনে আনন্দে নাচতে-নাচতে দেবকুমার ঘরে দৌড়ে এসে তাকে দেখল; তারপরে ঘৃণার সঙ্গে হাসতে-হাসতে বলল–কই, কোথায় আমার মা? কারণ, এখানে তো সেই নোংরা ভিখিরি মেয়েটা ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
ভিখিরি মেয়েটি বলল–আমিই তোমার মা।
দেবকুমার রেগে চিৎকার করে উঠল-তুমি উন্মাদ। তাই একথা বলছ। তোমার মতো নোংরা ভিখিরির ছেলে আমি নই। বেরিয়ে যাও। তোমার মুখ আমি দেখতে চাই নে।
না-না। তুমি আমার ছেলে। তোমাকে নিয়ে আমি বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ডাকাতরা তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ওইখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু তোমাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। তোমার গায়ে যে সব চিহ্ন ছিল সেগুলিও আমি চিনেছি। অনুরোধ করছি, তুমি আমার সঙ্গে এস। চল পুত্র; তোমার স্নেহের ভিখারি আমি।
কিন্তু দেবকুমারকে নড়ানো গেল না। তার মায়ের কান্নাও তার মনে কোনো করুণার উদ্রেক করতে পারল না। ভিখারিণী যন্ত্রণায় কেবল কাঁদতে লাগল।
শেষকালে সে কথা বলল; বেশ রুক্ষ আর তিক্ত তার স্বর–যদি সত্যিই তুমি আমার মা হও তাহলে তোমার উচিত ছিল আমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকা। এভাবে আমার জীবনে কলঙ্কের ছাপ দিতে আসা উচিত ছিল না তোমার। ভেবেছিলাম আমি কোনো দেবদূত–তোমার কাছে এখন যা শুনছি–কোনো ভিখারিণীর ছেলে আমি। সুতরাং তুমি এখান থেকে দূর হয়ে যাও। তোমার মুখ আমি দেখতে চাই নে।
ভিখারিণী কেঁদে বলল–হায় পুত্র, চলে যাওয়ার আগে তুমি কি আমাকে একটা চুমুও খাবে না?
সে বলল–না, তুমি দেখতে বড়ো কুচ্ছিত। তোমাকে চুমু খাওয়ার চেয়ে আমি বরং সাপকে চুমু খাব, চুমু খাব পথের ধুলোকে।
সুতরাং ভিখারীণী কাঁদতে কাঁদতে বনের দিকে চলে গেল। সে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে দেখে দেবকুমার খুব খুশি হয়ে তার সঙ্গীদের কাছে খেলতে ছুটে গেল।
কিন্তু তারা তাকে বিদ্রূপ করে বলল–তুমি কটকটে ব্যাঙের মতো বিশ্রী দেখতে; সাপের মতো ঘৃণ্য। এখানে থেকে দূর হয়ে যাও। আমরা তোমার সঙ্গে খেলব না।
এই কথা শুনে দেবকুমার ভ্রু কুঁচকে নিজের মনে বলল–এরা বলে কী? আমি পাতকূয়ার কাছে গিয়ে জলের দিকে তাকাব; পাতকূয়ার জলই বলে দেবে আমি কত সুন্দর।
এই পাতকুয়ার কাছে গিয়ে সে জলের দিকে তাকাল। হায়, হায়! তার মুখ হয়েছে কটকটে ব্যাঙের মুখের মতো; তার গায়ে গড়িয়েছে সাপের গায়ের মতো আঁশ। এই দেখেই ঘাসের ওপরে লম্বা হয়ে শুয়ে কাঁদতে-কাঁদতে সে বলল–নিশ্চয়ই এটা আমার পাপের ফল। অস্বীকার করে আমি আমার মাকে তাড়িয়ে দিয়েছি! আমি দাম্ভিত; মায়ের ওপরে আমি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছি। যতদিন না আমি মাকে খুঁজে পাই ততদিন সারা বিশ্ব আমি ঘুরে বেড়াব, বিশ্রাম নেব না এতটুকু।
কাঠুরের বাচ্চা মেয়েটি তার কাছে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বলল–তুমি কেঁদ না, আমাদের কাছে তুমি থাক; আমি তোমাকে ঠাট্টা করব না।
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে বলল–না। মায়ের ওপরে আমি দুর্ব্যবহার করেছি। তাই তাঁকে খোঁজার জন্যে আমি সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াব। কোথাও থামব না।
এই কথা বলেই তার মাকে ডাকতে ডাকতে সে বনের দিকে দৌড়ে গেল। কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। সারা দিন ধরেই সে চেঁচাতে লাগল। তারপরে রাত্রি নেমে এলে সে শুকনো পাতা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু পশু-পাখিরাও তার কাছ থেকে পালিয়ে গেল। কারণ তার নিষ্ঠুরতার কথা তারাও জানত। তার সঙ্গী হয়ে রইল কেবল কটকটে ব্যাঙ আর সাপের দল।