এই বলে পরম যত্নে শিশুটি সে কোলে তুলে নিল, ঠান্ডার হাত থেকে তার নরম দেহটাকে বাঁচানোর জন্যে সেই আলখাল্লাটা দিয়ে বেশ ভালো করে তাকে জড়াল, তারপরে তার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তার এই মূর্খতা আর নরম হৃদয় দেখে তার সঙ্গীটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
তার স্ত্রী দরজা খুলে দিল। স্বামী নিরাপদে ফিরে এসেছে দেখে দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে সে চুমু খেল, তার কাঁধ থেকে খুলে নিল জ্বালানি কাঠ, জুতো থেকে সরিয়ে দিল বরফের কুচি, তারপরে ভেতরে আসতে বলল তাকে।
কিন্তু সে তার স্ত্রীকে বলল–বন থেকে আমি একটা জিনিস কুড়িয়ে এনেছি। আমার ইচ্ছে তুমি এর যত্ন নেবে।
তার স্ত্রী আনন্দে বলে উঠল-কী এনেছ–দেখি, দেখি! ঘরে আমাদের অনেক কিছু জিনিসের অভাব রয়েছে।
এই কথা শুনে সে আলখাল্লাটা সরিয়ে ঘুমন্ত শিশুটিকে দেখাল।
স্ত্রী তো রেগে গরগর করে উঠল-এ কী করেছ তুমি! শিশু! আমাদের নিজেদের ছেলেমেয়েই কি কম যে আর একজনকে তাদের খাবারের ভাগ দিতে হবে! তাছাড়া, কে জানে ও আমাদের দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে কি না। আর ওকে মানুষই বা আমরা করব কী করে?
সে বলল–কোনো দুর্ভাগ্য আনবে না; কারণ ও একটি দেবকুমার।
এই বলে সে সেই অদ্ভুত কাহিনিটি তার কাছে বর্ণনা করল।
কিন্তু স্ত্রীকে খুশি করা গেল না। সে ব্যঙ্গ করে বলতে লাগল আমাদের ছেলেমেয়েদেরই খাবার নেই, আবার পরের ছেলে এনেছে! এ-বিশ্বে আমাদের জন্যে ভাবনা করে কে? কে আমাদের খাবার দেয়?
সে বলল–চড়াই পাখিদের কথাও ঈশ্বর ভাবেন, তাদেরও খেতে দেন তিনি।
কিন্তু শীতকালে খেতে না পেয়ে সেই চড়াইরাও কি মারা যায় না? আর এখন কি সেই শীতকাল নয়?
লোকটি কোনো উত্তর দিল না; চৌকাঠ থেকে ভেতরেও ঢুকল না। বাইরে থেকে ঠান্ডা কনকনে বাতাস এসে তার স্ত্রীকে কাঁপিয়ে দিতে লাগল। কাঁপতে কাঁপতে তার স্ত্রী বলল–তুমি কি দরজাটা বন্ধ করবে না? বাইরে থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। আমি জমে গেলাম যে।
সে জিজ্ঞাসা করল–যে বাড়িতে কঠিনহৃদয় মানুষ বাস করে সেখানে সব সময় কি ঠান্ডা কনকনে বাতাসে বয় না?
কোনো উত্তর না দিয়ে তার স্ত্রী আগুনের ধারে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দিকে চাইল। তার চোখ দুটি তখন জলে ভরে উঠেছে। এই দেখে সে চট করে ভেতরে ঢুকে এসে শিশুটিকে তার কোলে দিয়ে দিল। সে শিশুটিকে চুমু খেয়ে তার সবচেয়ে বাচ্চা ছেলেটির পাশে শুইয়ে দিল। পরের দিন সকালে কাঠুরে সোনার তৈরি সেই অদ্ভুত পোশাকটিকে তাদের বড়ো সিন্দুকটার ভেতরে রেখে দিল। শিশুটির গলায় হলদে রঙের যে হারটা ছিল তার স্ত্রী সেটাও খুলে নিয়ে সেই সিন্দুকটার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল।
এইভাবে কাঠুরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সেই দেবকুমারটি বাড়তে লাগল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সৌন্দর্যও বাড়তে লাগল। গাঁয়ের সবাই তার সেই সুন্দর চেহারার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু সেই সৌন্দর্যই তার কাল হল। কারণ সে খুব গর্বিত, নিষ্ঠুর আর সেই সঙ্গে স্বার্থপর হয়ে উঠল। কাঠুরের আর অন্যান্যদের ছেলেমেয়েদের সে ঘৃণা করতে লাগল। তার নিজের জন্ম হয়েছে নক্ষত্রলোক থেকে আর তারা সবাই অশিক্ষিত বংশের এই কথা বলে তাদের ওপর সে প্রভুত্ব বিস্তার করল–তাদের দেখতে লাগল চাকর-বাকরের মতো। যারা দরিদ্র, অন্ধ অথবা বিকলাঙ্গ তাদের ওপরে তার কোনো মমতা ছিল না। তাদের দেখলেই সে ঢিল মেরে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিত। ফলে, এক ডাকাত ছাড়া আর কেউ তাদের গ্রামে আসতে সাহস করত না। নিজের সৌন্দর্যে সে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল যে পাদরির পাতকুয়ার ধারে গিয়ে জলের ভেতরে সারাদিনই প্রায় সে নিজের মুখ দেখত, আর তারিফ করত নিজের সুন্দর মুখমণ্ডলকে।
কাঠুরে আর তার স্ত্রী এই জন্যে তাকে প্রায়ই তিরস্কার করে বলত–দুঃস্থদের সঙ্গে তুমি যেরকম ব্যবহার কর, আমরা তো তোমার সঙ্গে সেরকম ব্যবহার করি নে। যারা করুণার পাত্র তাদের সঙ্গে তুমি অমন নিষ্ঠুর ব্যবহার কর কেন?
পাদরি তাকে প্রায়ই ডেকে এনে বলতেল-মাছিও তোমার ভাই, তাদের তুমি কোনো ক্ষতি করো না। বনের পাখিদেরও স্বাধীনতা রয়েছে। স্ফূর্তির জন্যে তুমি তাদের জাল পেতে ধরো না। কানা, খোঁড়া, ছুঁচো–সবাইকেই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। এই বিশ্বে তাদেরও একটা জায়গা রয়েছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে এই অনাচার করার তোমার অধিকার কী রয়েছে? এমন কি মাঠের গবাদি পশুরাও ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করে।
কিন্তু কোনো উপদেশই তার কানে ঢুকল না। নিজেকে সে এতটুকুও শোধরাল না। সে আগের মতোই সকলের ওপরে প্রভুত্ব করতে লাগল। সে যখন ছুঁচোর চোখে কাঠি ঢুকিয়ে দিত, অথবা কুষ্ঠরোগীকে ঢিল ছুঁড়ে মারত, তখন তারাও হাসত। এইভাবে গ্রামের ছেলেরাও তার মতো নির্দয় হয়ে উঠল।
একদিন গ্রামের পথ দিয়ে একটি ভিক্ষুক-রমণী যাচ্ছিল। তার পোশাক ছিঁড়ে গিয়েছিল, রাস্তা দিয়ে হাঁটার ফলে পা দিয়ে তার রক্ত পড়ছিল। তার অবস্থাটা সত্যিই বড়ো খারাপ দেখাচ্ছিল। ক্লান্ত হয়ে একটি বাদাম গাছের তলায় বসে সে বিশ্রাম করছিল।
তাকে দেখে সেই দেবকুমার তার সঙ্গীদের বলল–ওই সুন্দর গাছের তলায় একটা নোংরা কদর্য চেহারার ভিখিরি বসে রয়েছে দেখ। এস, ওকে আমরা তাড়িয়ে দিই।