এই সম্মানিত মন্ত্রীর কথাগুলি বেশ গম্ভীরভাবেই মুচকি-মুচকি হাসতে-হাসতে লর্ড ক্যানটারভিলে শুনছিলেন। মন্ত্রী মহোদয়ের কথা শেষ হওয়ার পরে তিনি বেশ হৃদ্যতার সঙ্গে তাঁর করমর্দন করে বললেন–প্রিয় স্যার, আপনার সুন্দরী কন্যা আমার হতভাগ্য পূর্বপুরুষ স্যার সাইমনের যথেষ্ট উপকার করেছে। সেদিক থেকে তার এই সাহসের জন্যে আমি এবং আমার বংশের সকলেই তার কাছে কৃতজ্ঞ। ওই অলঙ্কারগুলি ন্যায়ত তারই প্রাপ্য। তাছাড়া, হৃদযহীলের মতো ওই অলঙ্কারগুলি আমি যদি তার কাছ থেকে নিয়ে চলে যাই তাহলে আমায় বিশ্বাস সেই দুষ্ট বৃদ্ধটি এক পক্ষের মধ্যেই তার কবরখানা থেকে উঠে আমার। একেবারে প্রাণান্ত করে ছেড়ে দেবো উত্তরাধিকারের কথা যদি বলেন তাহলে বলতে পারি যে উইল-এ যা লেখা নেই তা কখনো উত্তরাধিকারীর প্রাপ্য নয়। ওই বব্লগুলির অস্তিত্ব আমরা কেউ জানতাম না। সেদিক থেকে বিচার করলে ওই রত্নগুলির ওপরে আমার যদি কোনো অধিকার থাকে, তাহলে আপনার হেড বাবুটিরও সেই একই অধিকার রয়েছে। তাছাড়া, মিঃ ওটিস আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে সভূত বাড়িটাকেই আপনি কিনেছিলেন; সুতরাং ভূতের যদি কোনো সম্পত্তি থেকে থাকে সে-সম্পত্তিও আপনারই। কারণ স্যার সাইমন রাত্রিতে বারান্দার ওপরে ঘুরে বেড়ালেও, আইনের দিক থেকে তিনি মৃত, এবং দাম দিয়েই আপনি তাঁর সম্পত্তি কেনে নিয়েছিলেন।
লর্ড ক্যানটারভাইলের এবম্বিধ প্রত্যাখ্যানে মিঃ ওটিস খুবই মর্মাহত হলেন, তাঁর মতটা পুনর্বিবেচনা করার জন্যে অনুরোধও আর একবার তাঁকে করলেন, কিন্তু সৎ-বুদ্ধিসম্পন্ন লর্ড তাঁর মতে অবিচল হয়ে রইলেন। ভূতের সম্পত্তি রেখে দেওয়া ছাড়া মিঃ ওটিসের আর কোনো উপায় রইল না।
১৮৯০ সালের বসন্তকালে যখন চেশায়ারের যুবতী ডাচেসের বিবাহ উপলক্ষে তাকে রানির প্রথম ড্রয়িংরুমে নিয়ে যাওয়া হল তখন সবাই তার অলঙ্কারগুলি দেখে একেবারে ধন্য-ধন্য করে উঠল। ভার্জিনিয়া আর যুবক ডিউকের বিয়েতে সবাই আনন্দিত হল; কারণ এমন রাজযোটক মিল নাকি সহজে কারও চোখে পড়ে না। খুশি হলেন না কেবল ডাম্বলটনের মারশনেস। ভদ্রমহিলার সাতটি অবিবাহিতা কন্যা ছিল। তাদের একটিকে ডিউকের ঘাড়ে চাপানোর জন্যে তিন তিন বার বেশ মোটা খরচ করে ডিনার পার্টি দিয়েছিলেন আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হচ্ছে সেই পার্টিতে মিঃ ওটিসকেও তিনি নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মিঃ ওটিস ডিউককে খুবই পছন্দ করতেন; কিন্তু নীতিগতভাবে তার ওই খেতাবটি তাঁর কাছে ছিল বড়োই অবান্তর। কিন্তু আপত্তি শেষ পর্যন্ত তাঁর ধোপে টেকেনি। আমার মনে হয় বর আর বধূ হাত ধরাধরি করে যখন সেন্ট জর্জ গির্জার বেদির কাছে ঘুরছিল তখন ইংলন্ডের মধ্যে মিঃ ওটিসের মতো গর্বিত মানুষ আর কেউ ছিল না।
বিবাহ বাসর উদযাপন করে ডিউক আর ডাচেস ক্যানটারভিলে চেস-এ যেদিন ফিরে এল তার পরের দিন বিকেলের দিকে তারা হাঁটতে হাঁটতে পাইনবনে ঘেরা নির্জন সমাধির কাছে হাজির হল। স্যার সাইমনের সমাধি ফলকটি খুঁজে বার করতে তাদের কষ্ট হয়েছিল যথেষ্ট। ডাচেস সঙ্গে নিয়ে এসেছিল কয়েকটি সুন্দর গোলাপ। সেইগুলি সে সমাধির ওপরে ছড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে তারা ধ্বংসপ্রায় সমাধিগুলির চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সেইখানে একটি ভাঙা স্তম্ভের ধারে ডাচেস বসে পড়ল, সিগারেট খেতে-খেতে ডিউক তার পায়ের কাছে বসে তার সুন্দর চোখ দুটির দিকে রইল তাকিয়ে। ডিউক হঠাৎ তার সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে ডাচেসের হাতটা ধরে বলল–ভার্জিনিয়া, কোনো স্ত্রীর তার স্বামীর কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রাখা উচিত নয়।
প্রিয় সিসিল, আমি তো কিছু লুকিয়ে রাখিনি।
ডিউক হেসে বলল–রেখেছ। ভূতের সঙ্গে ঘরের মধ্যে থাকার সময় তোমার কী কথা হয়েছিল সেকথা তো বলনি।
ভার্জিনিয়া গম্ভীরভাবে বলল–সেকথা আমি কাউকে বলিনি।
আমি তা জানি; কিন্তু আমাকে বলতে পার।
দয়া করে আমাকে তা বলতে বলো না, সিসিল। আমি তা বলতে পারব না। হতভাগ্য স্যার সাইমন! তাঁর কাছে আমি সত্যিই বড়ো ঋণী। হেসো না, সত্যিই বলছি ঋণী। তাঁর কাছ থেকেই আমি বুঝতে পরেছি জীবন কী জিনিস, মৃত্যু বলতে কী বোঝায়; আর প্রেম ওদের চেয়ে কেন মহত্তর।
ডিউক উঠে তার স্ত্রীকে চুমু খেল।
তোমার ওই হৃদয়টা যতক্ষণ আমার থাকবে ততক্ষণ ওই কথাটা তুমি গোপন করেই রেখ।
আমার হৃদয় চিরকাল তোমারই থাকবে, সিসিল।
আমাদের সন্তানদের সেই কথাটা একদিন তুমি বলবে–বলবে না?
লজ্জায় ভার্জিনিয়ার মুখটা লাল হয়ে উঠল।
দেবকুমার
The Star-Child
একদিন দুজন দরিদ্র কাঠুরিয়া বিরাট একটা পাইন বনের ভিতর দিয়ে হাঁটছিল। শীতকাল। ঠান্ডা কনকনে রাত। মাটির ওপরে গাছের পাতায় বেশ পুরু পুরু বরফ জমেছে। তাদের পথের দু’পাশে ঘন বরফের চাঁই মটমট করে পল্লবগুলিকে ভেঙে দিচ্ছে। হাঁটতে-হাঁটতে যখন তারা পাহাড়ি ঝর্নার কাছে এল তখন ঝর্নাটা নির্জীব হয়ে বাতাসে ঝুলছে; কারণ, বরফ-রাজ তাকে চুমু খেয়েছে। এত ঠান্ডা যে কী করবে তা তারা ভেবে পেল না।
দুটো পায়ের ভেতরে ন্যাজটা ঢুকিয়ে দিয়ে বনের মধ্যে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে নেকড়ে বাঘ ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলল–উঃ! আবহাওয়া বটে একখানা! সরকার এ-সম্বন্ধে কোনো ব্যবস্থা করে না কেন?