সকলের সঙ্গে ভার্জিনিয়া এতক্ষণ রসিকতা করছিল এই মনে করে মিঃ ওটিস রাগ করে বললেন–হা ঈশ্বর! এতইড্রণ তুমি কোথায় ছিলে? আমরা তোমার খোঁজে সারা দেশটা ঘুরে বেডালমা তোমার মা তো ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছেন। আর কোলোদনি এইরকম বাস্তব ঠাট্টা তুমি করবে না বলে দিচ্ছি।
নাচতে-নাচতে যমজ ভাই দুটি বলল–অবশ্য এক ভূতের ওপরে ছাড়া।
ভার্জিনিয়া শান্তভাবে বলল–বাবা, আমি ভূতটির কাছেই এতক্ষণ ছিলাম। সে মারা গিয়েছে। তোমরা তাকে দেখবে চলা সে সত্যিই বড়ো পাপ করে ছিল। তার জন্যে সে অনুতপ্ত হয়েছে। মারা যাওয়ার আগে সে আমাকে এই সব মণিমুক্তো দিয়ে গিয়েছে।
তার সেই গম্ভীর থমথমে ভাব দেখে সবাই তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে তাঁদের ভাঙা দেওয়ালের ভেতর দিয়ে সরু একটা গোপন বারান্দায় নিয়ে এল। বাতি জ্বালিয়ে ওয়াশিংটন তাঁদের পিছু পিছু চলতে লাগল। অবশেষে তাঁরা একটি ওক কাঠের বিরাট দরজার সামনে উপস্থিত হলেন। সেই দরজার গায়ে মরচে-পড়া পেরেক গাঁথা রয়েছে। ভার্জিনিয়া তার গায়ে হাত দিতেই সেটা হাট হয়ে খুলে গেল। তাঁরা একটা চোরা কুঠরির মধ্যে হাজির হলেন। এর ছাদ নীচু। একটা মাত্র ভারি দেওয়া ছোটো ঘনালা সেই ঘরে রয়েছে দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথা রয়েছে বিরাট একটা লোহার বালা। তার সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা একটা শীর্ণ কঙ্কাল। মেঝের ওপরে লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছে কঙ্কালটি। তার কাছ থেকে একটু দূরে নাগালের বাইরে একটা পুরনো খাবারের পাত্র আর কলসি বসানো। দেখে মনে হল কঙ্কালটি তার শীর্ণ হাত দিয়ে সেই দুটি পাত্রকে ধরার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওই কলসিতে সম্ভবত একদিন জল ছিল। সেই জলের সবুজ দাগ এখনো তার ভেতরে লেগে ছিল। ভার্জিনিয়া সেই কঙ্কালের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে হাত দুটি জড়ো করে নিঃশব্দে প্রার্থনা করল। বাকি সবাই সেই করুণ ঘটনাটির দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এই ঘটনাটি তখনো পর্যন্ত অনাবিষ্কৃতই ছিল।
ওই কুঠরিটা বাড়ির কোন অংশে তা জানার জন্যে যমজ ভাই দুটি এতক্ষণ জানালা দিয়ে। বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–দেখ, দেখ ওই শুকনো বাদাম গাছে ফুল ফুটেছে। এখান থেকে আমি তা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি।
দাঁড়িয়ে উঠল ভার্জিনিযা। তার মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়ল একটি স্বর্গীয় দ্যুতি। সে বলল–ঈশ্বর ওঁকে ক্ষমা করেছেন।
ডিউক চেঁচিয়ে বলল–তুমি একজন দেবকুমারী ভার্জিনিয়া।
এই বলে ভার্জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে সে তাকে চুমু খেল।
এই অদ্ভুত ঘটনার চারদিন পরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন হল। শবযাত্রা শুরু হল ক্যানটারভিলে চেস থেকে রাত্রি প্রায় এগারোটার সময়। আটটি কালো ঘোড়া শবাধারটিকে টেনে নিয়ে গেলা ঘোড়ার মাথায় ছিল উটপাখির পালকের নিশান। সীসের কফিনের ওপরে ঢাকা ছিল লাল কাপড়ের একটা আবরণ; তার ওপরে আঁকা ছিল ক্যানটারভিলে কোর্ট-অফ-আর্মস। শবাধারবাহী গাড়ির আশেপাশে মশাল জ্বালিয়ে চলছিল। চাকর-বাকরদের দল। সমস্ত শোভাযাত্রাটিই বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। প্রধান শোককর্তা। ছিলেন লর্ড ক্যানটারভিলে। ওযেলস থেকে বিশেষ করে এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ। করতেই তিনি এসেছিলেন। ভার্জিনিয়ার সঙ্গে তিনি বলেছিলেন প্রথম গাড়িটিতে। তারপরে ছিলেন সস্ত্রীক যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী, তারপরে ওয়াশিংটন তিনটি ছেলে তারপরে। সকলের শেষে ছিলেন মিসেস উমনে। তাঁর জীবনের পঞ্চাশটি বছর ভূতটি তাঁকে বিব্রত করেছিল বলেই তিনি যে তার শেষকৃত্যটা দেখবেন এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। গির্জার এক কোণে বৃদ্ধ একটি ইউ গাছের তলায় গভীর গর্ত খোঁড়া হল। রেভা, আগস্টাস ডামপির বেশ গম্ভীর। পরিবেশের মধ্যে প্রার্থনার পদগুলি পড়লেন। অনুষ্ঠান শেষ হলে ক্যানটারভিলে বংশের প্রথা অনুযায়ী চাকররা তাদের মশালগুলি নিবিয়ে দিল। কফিনটাকে মাটির তলায় নামানোর সময় ভার্জিনিয়া এগিয়ে গিয়ে সাদা আর ফিকে রঙের বাদামের ফুল দিয়ে তৈরি করা বড়ো একটা ক্রুশ তার ওপরে রাখলে মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে চাঁদ উঠল আর সেই ছোটো গির্জার কবরখানাতে ছড়িয়ে দিল রুপোর আলো। দূর থেকে গান করতে লাগল একটি নাইটিংগেল পাখি।
পরের দিন সকালে লর্ড ক্যানটারভিলে শহরে ফিরে যাওয়ার আগে ভূতটি ভার্জিনিয়াকে যে মুক্তোর বাক্সটি দিয়েছে সে সম্বন্ধে মিঃ ওটিস তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে বসলেন। মুক্তোর। গ্যগুলি ষোড়শ শতাব্দীর; মূল্য আর শিল্পকলার দিক থেকে সেগুলি অনবদ্য। তাই সেগুলি গ্রহণ করতে মিঃ ওটিসের বিবেকে লাগছিল। তিনি বললেন–মি লর্ড, এদেশে দানপত্রের সঙ্গে ডামি আর ছোটোখাটো অলঙ্কার দেওয়ার প্রথা রয়েছে। আর এটা আমার কাছে খুবই পরিষ্কার যে ওই সব অলঙ্কারগুলিই নীতিগতভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে আপনারই বংশের প্রাপ্য। সেই জন্যে বিশেষ একটি অজ্ঞাত পরিস্থিতিতে আবিষ্কৃত ওই রত্নগুলি সঙ্গে নিয়ে লন্ডনে যেতে আপনাকে আমি অনুরোধ করছি। আমার মেয়ের কথা যদি বলেন তাহলে বলব ও হচ্ছে বাচ্চা। তাছাড়া, ওই রকম অলঙ্কার নিয়ে, অলস বিলাসিতায় জীবন কাটাতেও সে অভ্যস্ত বা উৎসুক নয। মিসেস ওটিসের আর্টের বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। কারণ বাল্য বযসে কয়েকটি শীত তিনি বেস্টলে কাটিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন যে ওই । অলঙ্কারগুলি বিক্রি করলে অনেক দাম পাওয়া যাবে। এই সব কারণে লর্ড ক্যানটারভিলে, আপনি বেশ বুঝতে পারছেন ওইগুলি আমার পরিবারে কেন রাখতে আমি রাজি হচ্ছি নে। আর সত্যি কথা বলতে কি এই সব মূল্যবান জমকালো অলঙ্কার ব্রিটিশ অভিজাত সম্প্রদাযের কাছে যতই গৌরবজনক বলে মনে হোক না কেন আমাদের মতো যারা। রিপাবলিকানের সাধারণ আর অমর নীতিতে মানুষ হয়ে উঠেছে তাদের কাছে ওদের কোনো দাম নেই। অবশ্য একথাটা আমি উল্লেখ করতে চাই যে আপনার হতভাগ্য আর বিপতগামী। পূর্বপুরুষের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে ওই বাক্সটি নিজের কাছে রাখতে পারলে ভার্জিনিয়া খুশি হবে বাক্সটা অতি পুরাতন আর সেই সঙ্গে সংস্কারের বাইরে চলে গিয়েছে বলেই আমার ধারণা। আমার অনুরোধ রাখাটা আপনার কাছে কষ্টকর হবে না। আমার কথা যদি বলেন তাহলে একথা বলতে আমি বাধ্য যে আমার কোনো সন্তানের মধ্যযুগীয় কোনো জিনিসের ওপরে যে। আকর্ষণ রয়েছে তা জানতে পেরে আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছি। এর একমাত্র কারণ সম্ভবত এই যে মিসেস ওটিস এথেন্স থেকে ফেরার পথে লন্ডনের একটি শহরতলিতে দিন কতক যখন অবস্থান করছিলেন সেই সময়েই ওর জন্ম হয়েছিল।