মিনিট দশেক পরে চা খাওয়ার ঘন্টা পড়ল। ভার্জিনিয়া না আসায় মিসেস ওটিস তাকে ডেকে আনার জন্যে চাকর পাঠালেন। কিছুক্ষণ পরে চাকরটি ঘুরে এসে জানাল তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ডিনার টেবিলের জন্যে ভার্জিনিয়া প্রতিদিন বাগানে ফুল তুলতে যেত। সেইজন্যে মিসেস ওটিস প্রথমে বিশেষ ভয় পাননি। কিন্তু ছ’টা বাজার পরেও যখন ভাডিনিযা এল না তখনই তিনি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। উদ্বিগ্ন হয়েই ছেলেদের পাঠিয়ে দিলেন তার খোঁড়ে; আর মিঃ ওটিস-এর সঙ্গে নিজে প্রতিটি ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। সাড়ে ছ’টা নাগাদ ছেলেরা ফিরে এসে ডানাল তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা সকলেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন এবং সেই বিশেষ ক্ষেত্রে কী করা উচিত সে সম্বনে কেউ কিছু ঠিক করতে পারলেন না। ঠিক এই সময় হঠাৎ মিঃ ওটিসের মনে পড়ল যে দিন কয়েক। আগে একদল জিপসিকে তাঁর পার্কে তাঁবু ফেলতে অনুমতি দিয়েছিলেন। সেইজন্যেই বড়ো ছেলে আর দুটি চাকরকে নিয়ে তিনি ‘ব্ল্যাকফেল হলো’র দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। জানতেন জিপসিরা ওখানেই তখন রয়েছে। বাচ্চা ডিউক তো মরিয়া হয়ে বলল সেও সঙ্গে যাবে। কিন্তু মারামারি বাধতে পারে এই ভয়ে মিঃ ওটিস রাজি হলেন না। সেইখানে উপস্থিত হয়ে তিনি দেখলেন জিপসিরা চলে গিয়েছে–আর চলে গিয়েছে হঠাৎ ওয়াশিংটন আর দুটি চাকরকে চারপাশ খুঁড়তে বলে তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে দেশের সর্বত্র পুলিশকে টেলিগ্রাম করে দিলেন এই বলে যে জিপসিরা একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। তারপরে তিনি ঘোড়া থামাতে বলে স্ত্রী আর তিনটি ছেলেদের ডিনারে বসতে বললেন। তারপরে একটা চাকরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে ছিলেন অ্যাসকট রোড-এর দিকে। মাত্র দু’মাইলও তিনি যাননি এমন সময় তাঁর মনে হল কে যেন ঘোড়ায় চেপে তাঁর। পেছনে-পেছনে আসছে। ঘুরে চেয়ে দেখলেন টাটুতে চেপে ডিউক দৌড়ে আসচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ছেলেটি বলল–আমি অত্যন্ত দুঃখিত, মিঃ ওটিস; কিন্তু ভার্জিনিয়াকে না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত আমি খেতে পারলাম না। আমার ওপরে দমা করে রাগ করবেন না। গত বছর আমাদের বিয়েথে আপনি যদি রাজি হতেন তাহলে এসব ঝামেলা বাধত না। আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না তো? আমি যেতে পারি নে। আমি যাব না।
মন্ত্রী সেই সুন্দর সব-সময় বিপদাপন্ন যুবকটির দিকে চেয়ে না হেসে পারলেন না। ভার্জিনিয়ার ওপরে তার এই আকর্ষণ দেখে মুগ্ধও হলেন একটু। সেই জন্যে ঘোড়া থেকে একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন–ঠিক আছে সিসিলা ফিরে যেতে না চাইলে নিশ্চয় তুমি আমার সঙ্গে আসবে। কিন্তু অ্যাসকট-এ গিয়ে তোমার জন্যে একটা টুপি কিনে দেব চল।
এই বলেই দুজনে ঘোড়ায় চড়ে রেল স্টেশনের দিকে ছুটলেন। সেখানে স্টেশন মাস্টারকে ডিজ্ঞাসা করলেন ভার্জিনিয়ার চেহারার কাউকে স্টেশনে দেখা গিয়েছে কি না। কিন্তু সেখানে তার কোনো সংবাদ পাওয়া গেল না। স্টেশন মাস্টার অবশ্য চারপাশে তার পাঠিয়ে দিয়ে জানালেন যে চারপাশে তাকে খুঁজে বার করার জন্যে তীক্ষ্ণ প্রহরী রাখা হবে। এই শুনে ডিউকের জন্যে একটা টুপি কিলে মিঃ ওটিস বেকসলের দিকে ছুটলেন। জায়গাটা ওখান। থেকে মাইল চারেক দূরে একটা গ্রাম। তিনি শুনেছিলেন ডাযগাটার পাশেই বিরাট একটা মাঠ থাকায় জিপসিরা সাধারণত ওইখানে ডেরা পাততে ভালোবাসে। সেখানে গিয়ে তাঁরা গ্রাম্য চৌকিদারকে ডেকে তুললেন; কিন্তু ভার্জিনিয়ার কোনো সংবাদ সে দিতে পারল না। কোথাও কোনো সংবাদ না পেয়ে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে তাঁরা বাড়িতে ফিরে এলেন। লন্ঠন নিয়ে গেটের কাছে ওয়াশিংটন আর দুটি যমজ ভাই তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ভার্জিনিয়ার কোথাও কোনো সংবাদ নেই। আবার অন্বেষণ শুরু হল; কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল তাঁদের। সপষ্টই বোঝা গেল অন্তত সেই রাত্রির মতো ভার্জিনিয়াকে তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। খুব দুঃখের সঙ্গে ঘোড়া দুটিকে সহিমের হাতে তুলে দিয়ে মিঃ ওটিস ছেলেদের নিয়ে পায়ে হেঁটে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। ঘরে এসে সবাই দেখলেন চাকররা সব ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে। মিসেস ওটিস একটা সোফার ওপরে শুয়ে রয়েছেন। উদ্বেগে তিনি অস্থির হয়ে উঠেছেন। ওকটি পরিচারিকা তাঁর কপালে ও-ডি-কোলন-কোলন দিচ্ছে। মিঃ ওটিস মুখে কিছু দেওয়ার জন্যে তাঁকে বারবার অনুরোধ করে আর সকলের জন্যে ডিনার তৈরি করতে নির্দেশদিলেন। খুবই দুঃখের সঙ্গেই আহারপর্ব সমাধা হল তাঁদের। খাওয়ার সময় কেউ কোনো কথা বলল না। খাওয়ার শেষ হওয়ার পরে সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করেই সবাইকে তিনি ঘুমাতে যাওয়ার হুকুম দিলেন। যে হেতু তাঁদের দিক থেকে করণীয় কিছু নেই সেই হেতু তিনি ঠিক করলেন একজন ডিটেকটিভকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে। পরের দিন সকালেই তিনি স্কটল্যানড ইয়ার্ডে টেলিফোন করবেন। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসার সমঘে গম্বুজের ঘড়িতে বারোটা। বাজার শব্দ হল; আর বারোটার শেষ ঘন্টাটি পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে হাঠৎ যেন কিছু একটা ভেঙে পড়ে যাওয়ার শব্দ এল; সেই সঙ্গে শোনা গেল অকস্মাৎ তীব্র একটা আর্তনাদ। ভয়ঙ্কর বজুপাতে কেঁপে উঠল বাডি, অপার্থিব সঙ্গীতের একটা সুর ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে, বিকট শব্দে সিড়িঁর মাথার ওপরে একটা কাঠের তক্তা ভেঙে পড়ল; আর তারই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিবর্ণ মুখে ভার্জিনিয়া। তার হাতে একটা ছোটো বাক্স। মুহূর্তের মধ্যে সবাই তার দিকে ছুটে গেলেন। মিসে ওটিস দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন তাকে, ডিউক তাকে চুম্বনে চুম্বনে অস্থির করে তুলল; আর সকলকে ঘিরে যমজ ভাই দুটি উন্মাদের মতো নাচতে শুরু করল।