আপনি কিছুই জানেন না। আপনার উচিত আমেরিকা গিয়ে নিজের মানসিক বৃত্তির উন্নতি করা। আমেরিকায় বিনা খরচে যদি যেতে চান তাহলে আমার বাবা আপনাকে খুশি হয়েই সাহায্য করতে পারেন। যদিও ওখানে সব রকম ‘সিপরিটের’ ওপরেই বেশ মোটা সুল্ক রয়েছে তবু কাস্টমস-এর হাত থেকে রেহাই পেতে খুব একটা অসুবিধে হবে না। কারণ, ওই বিভাগের অফিসাররা সবাই ডেমোক্র্যাট। একবার নিউ ইয়র্কে হাজির হলেই আপনি নিশ্চয় উন্নতি করবেন। আমি জানি সেখানে এমন অনেক লোক রয়েছে যারা পিতামহ সংগ্রহ করার জন্যে এক লষ্ক ডলার দিতে রাজি হবে; আর ঘরোয়া ভূত পেলে তো কথাই নেই।
-না। আমেরিকা আমার ভালো লাগবে না।
ভার্জিনিয়া ব্যঙ্গের সুরে বলল–মনে হচ্ছে আপনার কোনো ধ্বংসও নেই, কোনো কৌতূহলও নেই।
ধ্বংসও নেই! কৌতূহলও নেই! তোমাদের আছে নৌবিভাগ আর আচার!
আমি চললাম। বাবাকে দিয়ে বলি যমজ ভাইদের জন্যে যেন তিনি আরো এক সপ্তাহের ছুটির দরখাস্ত করেন।
ভূত চিৎকার করে উঠল-না, না। আমি নিঃসঙ্গ, বড়ো দুঃখ আমার। কী যে করি বুঝতে পারছি নে। আমি ঘুমোতে চাই; কিন্তু ঘুমোতে পারছি নে।
কী কথা যে বলেন! ঘুমোতে হলে স্রেফ বিছানায় শুয়ে বাতিটা নিবিয়ে দিন। মাঝে-মাঝে জেগে থাকাটা বড়ো কষ্টকর মনে হয়, বিশেষ করে গিড়ায। কিন্তু ঘুমোতে কোনো অসুবিধে নেই। এমন কি শিশুরাও ঘুমোতে জানে। তাদের যে বেশি বুদ্ধি রয়েছে সেকথা আপনিও স্বীকার করবেন না।
ভূত খুব দুঃখের সঙ্গে বলল–তিনশো বছর আমি ঘুমোইনি।
কথাটা শুনে ভার্জিনিয়ার সুন্দর চোখ দুটি অবার বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
ভূত বলে গেল–তিনশো বছর আমি ঘুমোইনি। আমি বড়ো ক্লান্ত।
ভার্জিনিয়া বলল–হতভাগ্য, হতভাগ্য ভূত! তোমার কি ঘুমানোর কোনো জায়গা নেই?
নীচু স্বপ্নালু স্বরে ভূত বলল–দূরে…দূরে পাইলবন ছাড়িয়ে ছোটো একটা বাগান রয়েছে। সেখানে লম্বা ঘাস ঘন হয়ে উন্মেছে। সাদা হেমলক ফুলের সমারোহ ভেগেছে সেখানে। সারা রাত ধরে নাইটিংগেল পাখি সেখানে গান করে। সেখানে ঘুমন্ত আত্মার মাথার ওপর ইউ গাছগুলি তাদের বিরাট হাতগুলি দেয় ছড়িয়ে।
জলে ভার্জিনিয়ার চোখ দুটি ভিজে গেল; হাত দিয়ে মুখ ঢাকল সো আস্তে আস্তে সে। বলল–মৃত্যুর উদ্যানের কথা বলছ?
হ্যাঁ, মৃত্যু। মৃত্যু সত্যিই বড়ো মধুর। নরম তামাটে মাটির তলায় শুয়ে থাকা; মাথার ওপরে। ঘাসগুলি বীজন করবে কোন পেতে শুনবে স্তব্ধতার বাণী। ভূত-ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকবে না আর। সময়ের জ্ঞান যাবে হারিয়ে; জীবনকে ক্ষমা করা, নিজের মধ্যে শান্তিকে অনুভব করা। কী মধুর! তুমি আমাকে সাহায্য করতে পার? মৃত্যুর দ্বার আমার জন্যে তুমি খুলে দিতে পার। কারণ প্রেম তোমার সঙ্গী। আর মৃত্যুর চেয়ে প্রেমের ক্ষমতা অনেক বেশি।
কেমন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেল ভার্জিনিয়া। মনে হল সে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখছে।
তারপরে আবার কথা বলল ভূত। বাতাসের দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনাল তার স্বর: লাইব্রেরির জানালার ওপর পুরনো যে একটি ভবিষ্যৎবাণী লেখা রয়েছে তা কি তুমি পড়েছ?
মেয়েটি ওপর দিকে চোখ তুলে বলল–খুব পড়েছি। ভালো ভাবেই পড়েছি। অদ্ভুত কালো কালো অক্ষরে লেখা পড়া খুবই কষ্টকর। মাত্র দুটো লাইন লেখা রয়েছে। সোজা কথায় বললে দাঁড়ায়-কোনো সোনালি মেয়েকে দেখে পাপীর মুখ থেকে যেদিন প্রার্থনার বাণী উচ্চারিত হবে, যেদিন বন্ধ্যা বাদাম গাছে ফুলের সমারোহ জাগবে, যেদিন কোনো শিশু তার চোখের জল ফেলবে সেই দিনই সারা বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে যাবে। শান্তি নেমে আসবে ক্যানটারভাইলে। কিন্তু এর অর্থ যে কী তা আমি জানি নে।
সে দুঃখের সঙ্গে বলল–অর্থ হচ্ছে আমার পাপের জন্যে তোমাকে কাঁদতে হবে। কারণ, আমার চোখে কোনো জল নেই, আমার আত্মার জন্যে আমার সঙ্গে তোমাকে প্রার্থনা করতে হবে। কারণ, আমার কোনো বিশ্বাস নেই তারপর আমার সঙ্গে যদি তুমি মিষ্টি আর সদস। ব্যবহার করে থাক তাহলে মৃত্যুর দেবদূত আমাকে দয়া করবেন। অন্ধকারে তুমি ভয়াল ছায়াদের ঘুরে বেড়াতে দেখবে, অমঙ্গলের স্বর তোমার কানে কানে ফিস ফিস করে অনেক কিছু বলবে; কিন্তু তারা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, কারণ নরকের শক্তি শিশুর পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে না।
ভার্জিনিয়া কোনো উত্তর দিল না। তার দিকে তাকিয়ে গভীর নৈরাশ্যে ভূতটি তার নিজের হাত দুটো মোচড়াতে লাগল। হঠাৎ ভার্জিনিয়া বিবর্ণ মুখে উঠে দাঁড়াল। তার চেখের ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত আলোর জ্যোতি বেরোতে লাগল। সে শক্ত হয়ে বলল–আমি ভয় পাই লে; তোমার ওপারে দয়া দেখাতে দেবদূতকে আমি বলব।
একটা ক্ষীণ আনন্দের ধ্বনি তুলে সে উঠে দাঁড়াল, তারপরে তার হাতটা ধরে পুরনো যুগের ভঙ্গিমায় চুমু খেল। তার আঙুলগুলি বরফের মতো ঠান্ডা; ঠোঁট দুটো আগুনের মতো গরম। ভার্জিনিয়া কাঁপল না সে তাকে হাত ধরে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর দিয়ে নিয়ে গেল। বিবর্ণ দেওয়াল চিত্রের উপরে খুদে খুদে শিকারিদের চিত্র আঁকা রয়েছে। তারা তাদের শিঙা ফুকে তাকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করল। ‘খুদে ভার্জিনিয়া চলে যাও, চলে যাও।’ কিন্তু ভূত তার হাত শক্ত করে ধরে রইল। সে বন্ধ করে রইল তার চোখ দুটো। ভীষণ ভীষণ জানোয়াররা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সাবধান, ছোটো ভার্জিনিয়া, সাবধান। আর হয়তো আমরা তোমাকে দেখতে পাব না।’ কিন্তু ভূতটি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল এবং ভার্জিনিয়া তাদের। কথায় কান দিল না। ঘরের শেষে গিয়ে সে থেমে কী যেন বলল। ভার্জিনিযা তা বুঝতে পারল না। চোখ খুলে সে দেখল ঘরের দেওয়ালটা কুয়াশার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। তার সামনেই বিরাট একটা গর্ত। কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে। যেন তার পোশাক ধরে টানছে। ভূতটি বলল–তাড়াতাড়ি। তা না হলে বড়ো দেরি হয়ে যাবে।