এরই কয়েক দিন পরে একদিন ভার্জিনিয়া আর তার কোঁকড়ানো চুলওয়ালা প্রেমিক দুজনে ব্রকলে মাঠের দিকে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে গেল। একটা বুনো ঝোঁপ পেরোতে গিয়ে ভার্জিনিযা তার পোশাক এমন বিশ্রীভাবে ছিডল যে বাড়ি ফিরে সে ঠিক করল যাতে কেউ তাকে ওই অবস্থায় দেখতে না পায় সেই জন্যে সে পেছনের সিড়ি দিয়ে ঢুকবে। এই ভেবে সে ট্যাপেস্ট্রি চেম্বারের পাশ দিয়ে ছুটতে শুরু করল। চেম্বারের দরজাটা সামান্য একটু খোলা ছিল। তার মনে হল ভেতরে কেউ রয়েছে। তার মায়ের পরিচারিকা মাঝে-মাঝে ওইখানে বসে তার কাজকর্ম করত। সে ভাবল তাকেই সে তার পোশাকটা সেলাই করে দিতে বলবে। এই ভেবে। ঘরের ভেতরে উঁকি দিল। উঁকি দিয়েই একেবারে অবাক হয়ে গেল। স্বয়ং ক্যানটারভিলে ভূত বসে রয়েছে সেখানে। জানালার ধারে বসে বসে ইয়োলো গাছের শুকনো সোনালি ফুলগুলির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সোনালি ফুলগুলি বাতাসে উড়ছে; ঝডের আবেগে লাল পাতাগুল। উন্মত্ত আবেগে দীর্ঘ পথের ওপরে বেড়াচ্ছে নেচে। একটা হাতের ওপরে মাথাটা রেখে সে বসে রয়েছে। দেখলেই মনে হবে তার সারা সত্তার ওপরে মারাত্মক রকমের একটা অবসাদ নেমে এসেছে। একেবারে নিঃসঙ্গ পরিত্যাক্ত মনে হল তাকে। এ-অবসাদ তার আর নয়। ভূতটিকে ওই অবস্থায় দেখে প্রথমেই তার মনে হয়েছিল ছুটে পালিয়ে গিয়ে নিজেক ঘরে ঢুকে পড়া; কিন্তু তারপরেই কেমন যেন দয়া হল তারা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার বাসনায় ভার্জিনিয়া উদ্বুদ্ধ হয়ে হালকা পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। ভূতটি দুঃখ আর হতাশায় এতই মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল যে কথা না বলা পর্যন্ত ভার্জিনিয়ার উপস্থিতি সে টেরই পায়নি।
ভার্জিনিয়া বলল–আপনার জন্যে আমি দুঃখিত, কিন্তু আমার ভাইরা কালই ইটন-এ পড়তে চলে যাচ্ছে। এরপর থেকে আপনি যদি ভালোভাবে চলাফেরা করেন তাহলে আপনাকে আর। কেউ বিরক্ত করবে না।
সেই সুন্দরী মেয়েটি যে তার সঙ্গে কথা বলবে এটা ভাবতে না পেরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভূত বলল–আবোল-তাবোল বলে তো লাভ নেই–ভালোভাবে চলাফেরা করার কথা–সে অসম্বব–যা হয় না তাই, উদ্ভট ব্যাপার। আমাকে শেকলের শব্দ করতে কথা–সে অসম্ভব–যা হয় না তাই, উদ্ভট ব্যাপার। আমাকে শেকলের শব্দ করতে হবে, ঝাঁঝরির ভেতর দিয়ে গোঙাতে হবে–রাত্রিতে বারান্দায় বারান্দায় ঘুরে বেড়াতে হবে। অবশ্য ভালোভাবে। চলাফেরা বলাতে এই যদি তুমি বোঝতে চাও সেটা হল অন্য কথা। আমার অস্তিত্বের কারণ একমাত্র ওইগুলিই।
উঁহু! অস্তিত্ব বজায় রাখার ওটা করণই হতে পারে না। তাছাড়া, আপনি যে খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলেন তা আপনি নিজেও জানেন। যেদিন আমরা এখানে প্রথম এলাম সেইদিনই মিসেস উমনে আমাদের বলেছেন যে আপনি আপনার স্ত্রীকে খুন করেছিলেন।
ভূত বিরক্ত হয়ে বলল–সেকথা আমিও স্বীকার করি। কিন্তু সেটা আমার ঘরোযা ব্যাপার। সেবিষয়ে আর কারও কিছু বলার এক্তিয়ার নেই।
নীতির কথা শুরু হলে ভার্জিনিয়া মাঝে-মাঝে একটু গম্ভীর হয়ে পড়ে। এই কথা শুনে সে বলল–কাউকে হত্যা করাটা অন্যায়।
বস্তুনিরপেক্ষ নীতির সস্তা বাড়াবাড়িটাকে আমি ঘৃণা করি। আমার স্ত্রী ছিল একেবারে অকর্মা। সে কোনোদিন আমার জামার কলারে মাড় দিল না; আর রান্নার ব্যাপারে সে ছিল একেবারে অপদার্থ তোমাকে বলব কী, একবার হোগলে’ বলে আমি একটা খরগোস শিকার করেছিলাম। কী অদ্ভুত মাংস তার! তুমি জান সেটা কী বিশ্রী রান্না করল সে। একেবারে অখাদ্য। সে সব কথা থাকগে। সে সব চুকেবুকে গেছে। কিন্তু তাদের বোনকে খুন করলেও তার ভাইদের উচিত হয়নি আমাকে অনাহারে মেরে ফেলা।
অনাহারে মেরে ফেলা! হায় মিষ্টার ভূত, অর্থাৎ, স্যার সাইমন, আপনার কি খিদে পেয়েছে? আমার ব্যাগে স্যানডউইচ রয়েছে। খাবেন?
না, ধন্যবাদ। আজকাল আমি আর কিছু খাই নে। তুমি যে বললে এতেই আমি খুশি। তোমাদের ওই বর্বর, অসৎ, ভয়ঙ্কর আর যাচ্ছেতাই রুচির পরিবারবর্গের তুলনায় তুমি অনেক ভালো।
ভার্জিনিয়া মেঝের উপর পা ঠুকে বলল–চুপ। আপনি নিজেই বর্বর, ভয়ঙ্কর আর যাচ্ছেতাই আর অসৎ হওয়ার কথা যদি বলেন তা হলে বলতে হয় আপনিই আমার রঙের বাক্স থেকে রঙ চুরি করে লাইব্রেরি ঘরে ওই রক্তের দাগ এঁকেছিলেন। আমরা তো হেস মরে যাই। প্রথমে আপনি নিলেন সিঁদুরসুদ্ধ সব লাল রঙা ফলে, সূর্যাস্তের ছবি আঁকা আমার বন্ধ হয়ে গেল। তারপরে আপনি চুরি করলেন আমার এমারেন্ড-গ্রীন আর ক্রোম ইয়োলো। শেষকালে পড়ে রইল কেবল ইনডিগো আর চাইনিস হোয়াইট। এখন আমি চাঁদনি রাতের ছবি ছাড়া আর কিছুই আঁকতে পারি নে। এই দৃশ্য কেবল যে মনটাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে তাই নয়, আঁকাও বড়ো কষ্টকর। যদিও আমি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেম তবু এবিষয়ে আপনাকে আমি কিছু বলিনি। তাছাড়া, সমস্ত ব্যাপারটাই বড়ো হাস্যকর করাণ, রক্তের রঙ এমারেল্ড-গ্রীন হবে একথা কেউ কোনো দিন শুনেছে?
ভূতটি শান্ত আর বিনয়ের সঙ্গেই বলল–তা বটে। কিন্তু আমার করারই বা কী ছিল? আজকাল সত্যিকার রঙ পাওয়া মুস্কিল। তাছাড়া, তোমার ভাই যখন ‘প্যারগান। ডিটারজেনট’-এর সাহায্য নিলে তখন তোমার রঙ চুরি করতেই বা আমার দোষটা কোথায়? আর রঙের কথা যদি বল ওটা হচ্ছে রুচির কথা। ক্যানটারভিলেদের ধমনীতে নীল রক্ত বইছে–ইংলন্ডে সবচেয়ে গাঢ় নীলও বলতে পার; কিন্তু আমি ডালি তোমরা যারা আমেরিকান তাদের ওসব বালাই নেই।