সত্তর বছরেরও বেশি সে এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সত্যি কথা বলতে কি সুন্দরী লেডি বারবারা মোদিসকে সে যেদিন ভয়ে মুহ্যমান করে দিয়েছিল সেদিনই সে এই ভূমিকায় শেষ অভিনয় করেছিল। সেই ভয়েই সে বর্তমান লর্ড ক্যানটারভিলে-এর পিতামহের সঙ্গে বিয়ে। ভেঙে দিয়ে সুন্দর যুবক জ্যাক ক্যাসলটনের সঙ্গে গ্রেটনা গ্রীন-এ পালিয়ে গিয়েছিল; বলেছিল, সন্ধে আর ভোরে যে বাড়ির বারান্দায় ভুত ঘুরে বেড়ায দ্বন্দ্বযুদ্ধে বেচারা ড্যককে লর্ড ক্যানটারভিলে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। তারই ফলে এক বছরের ভেতরেই ভগ্নহৃদয়ে। লেডি বারবারা টানব্রিজ ওয়েলস-এ মারা গিয়েছিল। তবে সাজগোজটা শেষ বড়োই কঠিন। সেই সাজ সাজতে তার পুরো তিনটি ঘন্টা লাগল। অবশেষে সাজগোজ শেষ হলে নিজের চেহারা দেখে সে বেশ খুশিই হল। একটা বেজে পনেরো মিনিটের সময় সে তার কুঠরি থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে যে বারান্দার ওপরে এসে দাঁড়াল। নীল পর্দা ঝোলানো থাকায় যে ঘরে যমজ ভাই দুটি থাকতো তাকে ‘ব্লু বেড চেম্বার’ বলা হত। ভালোভাবে ঢোকার জন্যে সে ধাক্কা দিয়ে কপাটটা খুল দিলা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভারী জলের কুঁজো তার ওপরে পড়ে গেল; জল পড়ে তার চামড়া পর্যন্ত গেল ভিজে; ইঞ্চি দুয়েকের জন্যে তার বাঁ কাঁধটা। কোনোরকমে বেঁচে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বিছানার ওপর থেকে চাপা গলার হাসি ভেসে এল। সমস্ত ব্যাপারটা তার স্নায়ুগুলিকে এমনভাবে বিকল করে দিল যে সে অত্যন্ত। দ্রুতবেগে তার ঘরে ফিরে এল। পরের দিন প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগে সে শুয়ে রইল। তার একমাত্র সান্ত্বনা হল মাথাটাকে সে সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি; গেলে কী সাংঘাতিক বিপদ ঘটত তা। ঈশ্বরই জানেন।
সেই অভদ্র আমেরিকানদের ভয় দেখানোর বাসনা অতঃপর সে পরিত্যাগ করল। শব্দহীন শ্লিপার পায়ে দিয়ে বারান্দায় গুঁড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়িযেই সে খুশি হল; এই বেড়ানোর সময় ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে গলায় সে একটা লাল মাফলার জড়াত: পাশে যমজ ভাইরা তাকে আক্রমণ করে এই ভয়ে হাতে সে রাখত সেকেল একটা বন্দুক। শেষ ধাক্কা খেল সে ১৯শে সেপ্টেম্বর। কোনোরকম অপমানিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই এই মনে করে নীচের বিরাট ঘরে ঢোকার জন্যে সেদিন সে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী আর তাঁর স্ত্রীর যে দুটি ফটোগ্রাফ। ছিল–কিছুদিন আগেও ওখানে টাঙানো থাকত ক্যানটারভিলে বংশের ছবি, সেইদিকে তাকিয়ে সে ঠাট্টা করছিল তাঁদের। তার পরনে ছিল কবরখানার ধাঁচের পরিচ্ছন্ন অথচ লম্বা পোশাক, চোয়ালটা বাধা ছিল বেগনে রঙের কাপড়ের টুকরো দিয়ে হাতে ছিল কবর খননকারীর কোদাল। সত্যি কথা বলতে কি জোনাস দ্য গ্রেঙলেস’, অথবা ‘চার্টসে বার্ন-এর করপস স্ন্যাচার’-এর ভূমিকায় যে পোশাক সে পরেছিল এটা সেই রকম। তার এই অভিনয় ক্যানটারভিলেদের মনে রাখার কথা; কারণ এই থেকে প্রতিবেশী লর্ড রুফোর্ড-এর সঙ্গে তাদের সত্যিকারের বিবাদ শুরু হয়। রাত্রি প্রায় দুটো বেড়ে মিনিট পনেরো হয়েছে। যতদূর সে ডানত তখন কারও ঘুরে বেড়ানোর কথা নয়। রক্তের কোনো দাগ পড়েছে কিনা দেখার জন্যে সে যখন লাইব্রেরি ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঠিক সেই সময় অন্ধকার থেকে অকস্মাৎ তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্মত্তের মতো মাথার ওপরে হাত তুলে তার কানের কাছে চিৎকার করে বলল—বু-বু!!
অত্যন্ত ভয় পেয়ে গেল সে এবং সেই অবস্থায় ভয় পাওয়াটাই তার কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক। ভয় পেয়ে সে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেল, কিন্তু দেখল মিঃ ওটিস তাঁর বিরাট গার্ডেন সিরিঞ্জ’ নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছেন। এইভাবে দু’পাশে শত্রুর দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে, আর পালানোর কোনো প্রশস্ত পথ না পাওয়ার ফলে সে বিরাট লোহার স্টোভের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার ভাগ্য ভালো যে স্টোভটা লেবানো ছিল। চিমনির ভেতর দিয়ে কালিঝুলি মেখে এক কিম্ভতকিমাকার অবস্থায় শেষ পর্যন্ত নিজের ঘরে গিয়ে পৌঁছল সে।
এরপরে আর কোনোদিন সে রাত্রিতে বেড়াতে বেরতো না। যমজ ভাই দুটি অনেকবার তার। জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকত আর গোটা বারান্দাটায় সুপুরি ছড়িয়ে রাখত। এতে তাদের বাবা, মা আর চাকর-বাকর সবাই বিরক্ত হত। কিন্তু তাদের কাজ তার জন্যে ব্যাহত হয়নি। বেশ সপষ্টই বোঝা যায় ওদের ব্যবহারে সে এতই মর্মাহত হয়েছিল যে সে কিছুতেই বাইরে বেরতে পারেনি। ফলে মিঃ ওটিস তাঁর অপরূপ সাংস্কৃতিক আসর বসানোর আয়োজন করলেন। ছেলেরা সব নানাজাতীয় খেলায় মেতে উঠল, ভার্জিনিয়া তার টার্টু ঘোড়ার চেপে ঘুরতে লাগল রাস্তায় রাস্তায়, আর চেশায়াবের যুবক ডিউক তার ছুটির শেষ সপ্তাহটা কাটাতে এল ক্যানটারভিলে চেস-এ সবাই ভাবল ভুতটি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে এবং মিঃ ওটিস লর্ড ক্যানটারভিলেকে এ-বিষয়ে দীর্ঘ একটি পত্র লিখলেন। উত্তরে লর্ড তাঁর স্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন।
সেদিক থেকে ওটিস প্রতারিত হয়েছিলেন। কারণ অকেজো হলেও, ভূত বাড়ি ছাড়েনি। বরং একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে যখনই সে শুনল চেশায়ারের যুবক ডিউক ওখানে অতিথি হিসাবে আসছে তখনই সে আর একবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। এরই বাবার কাকা লর্ড ফ্রানসিস স্টিলটল ক্যানটারভাইলের ভূতের সঙ্গে পাশা খেলবে বলে কর্নেল বারবারির সঙ্গে একবার একশো গিনি বাজি ধরেছিলেন। পরের দিন সকালে তাস খেলার ঘরে মেঝের ওপরে তিনি অসহায় অবস্থায় পুষ্কাঘাতে পড়েছিলেন। তারপরে যদিও তিনি অনেক বছর বেঁচেছিলেন তবু আর কোনোদিন তিনি ‘ডবল সিকসেস’ ছাড়া আর কিছু বলতে পারেননি। যদিও এই ঘটনাটা তখনকার দিনে অনেকেই জানত তবু দুটি অভিজাত বংশের সম্ভ জন্যে ঘটনাটাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। স্টিলটনদের ওপরে তার যে প্রভাব এখনো রয়েছে সেটা প্রমাণ করার জন্যেই সে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাকুল হয়ে উঠল। সেই জন্য সে ঠিক করল ভার্জিনিয়ার প্রেমিকের কাছে সে ‘ভাম্পায়ার মউক’। অথবা ‘রডলেস বেনিডিকটাইন’-এর বেশ ধরে দেখা দেবে। এই অভিনয়টি লেডি স্টারটাপ ১৭৬৪ সালের নববর্ষের রাত্রিতে দেখেছিলেন দেখেই ভয়ে চিৎকার করতে করতে তাঁর ফিট হল;আর তাতেই তিন দিনের দিন তিনি মারা গেলেন। মারা যাওয়ার সময় নিকট আত্মীয় ক্যানটারভিলেদের তাঁর সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তিনি তাঁর সব সম্পত্তি তাঁর। লন্ডনের ওষুধ বিক্রেতাকে দিয়ে গেল। কিন্তু শেষকালে যমজ ভাইদের ভয়ে সেই পরিকল্পনা তাকে ছাড়তে হল।