এর আগে কোনো ভূত না দেখার ফলে সে স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তারপরে সেই ভয়ঙ্কর ভৌতিক প্রাণীটির দিকে তাড়াতাড়ি আর একবার তাকিয়ে নিয়েই সে তার ঘরের মধ্যে পালিয়ে গেল পালানোর সময় তার লম্বা চাদরটা ফেলে গেল বারান্দার ওপরে; আর মরচে-পড়া ছোরাটা পড়ে গেল মন্ত্রীমশাযের তোর ভেতরে। পরের দিন কালে। বাটলার সেটা কুড়িযে পায়। একবার নিজের নির্জন ঘরে হাজির হয়েই সে ঘরের বিছানার ওপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল; তারপরে কাপড়ের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলল নিজের মুখ। যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে সেই সাহসী ক্যানটারভিলে ভূতটি তার স্বাভাবিক অবস্থাটা ফিরিয়ে নিয়ে এল। তারপরে ঠিক করল সকাল হলেই সে নেমে গিয়ে দ্বিতীয় ভূতটির সঙ্গে কথা বলবে। সেই পরিকল্পনা অনুসারে ঠিক ভোর হয়-হয় এই রকম সময় সে সেই জাযগায় ফিরে গেল। ভাবল, একজন ভূতের চেয়ে দুঙন ভূতের শক্তি অনেক বেশি দুজনে মিলে তারা ওই যমড ভাই দুটিকে অনায়াসেই কায়দা করতে পারবে। যথাস্থানে হাজির হয়ে একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য তার চোখে পড়ল। ছায়া-মূর্তিটির নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে, কারণ তার সেই শূন্য। চকোটরে সেই লাল জ্যোতি আর নেই, সেই চকচকে কুকরিটা পড়ে গিয়েছে তার হাত থেকে; আর অসহায় ভাবে দেওয়ালের গায়ে সে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনোরকমে। দৌড়ে গিয়ে হাত দুটো দিয়ে সে তাকে ধরল; সভয়ে দেখল ধরার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথাটা ঘাড় থেকে বিচ্যুত হয়ে মেঝের ওপরে গড়িয়ে পড়ল; দেহটার কোমর গেল ভেঙে। সে দেখল। দু-সুতোর তৈরি একটা সাদা বিছানার চাদরকে সে জড়িয়ে ধরেছে। এই অদ্ভুত পরিবর্তনের অর্থটা হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে সে তাড়াতাড়ি সেই বিজ্ঞাপনটাকে মুঠোর মধ্যে ধরে। প্রভাতের আলোয় পড়তে লাগল। বাপরে, বাপ! বিশ্বের এই একটিমাত্র ভুত ছাড়া আর সব ভূতই মেকী! অতএব সাবধান। ঠকবেন না। ক্যানটারভিলে ভুত তো রেগে কাঁই আর সব ভুত মেকী। বিদ্যুতের মতো সব ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। তার সঙ্গে ফাজলামি করা হয়েছে, তাকে ধাপ্পা দেওয়া হয়েছে, প্রতারণা করা হয়েছে তার সঙ্গে। বৃদ্ধ ক্যানটারভাইলের চোখে তার স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে এল। ফোকলা মাডি দুটো চিপে ধরল সে। শীর্ণ হাত দুটো আকাশের দিকে উঁচিয়ে প্রাচীনতম যুগের রীতি অনুসারে চমৎকার বাকবিন্যাসের ভিত্তিতে সে প্রতিজ্ঞা করল–মোরগ যখন আনন্দের সঙ্গে দু’বার ডাকবে তখনই রক্তাক্ত কাজ সংগঠিত হবে; নিঃশব্দ পদসঞ্চারে তখনই বেরিয়ে যাবে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে।
এই ভয়ঙ্কর শপথ গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে লাল টালির ছাদ দেওয়া দূরের কোনো বাড়ি থেকে মোরগ ডেকে উঠল। একটা তিক্ত দীর্ঘ চাপা হাসি হেসে সে অপেক্ষা করতে লাগল। আধঘণ্টা ধরে সে অপেক্ষা করল; কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে, মোরগটা আর ডাকল না। অবশেষে সাড়ে সাতটার সময় বাড়ির চাকরানিরা এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আর সেখানে অপেক্ষা করতে পারল না। ব্যর্থ আশা আর ব্যর্থ উদ্দেশ্যের কথা ভাবতে ভাবতে কোনোরকমে সে। তার ঘের ফিরে এল। সেখানে গিয়ে প্রাচীন বীরত্বের ওপরে লেখা কয়েকটা বই ঘেটে সে দেখল। এই বইগুলি তার খুব প্রিয় ছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যখন সে ওই জাতীয় কোনো প্রতিজ্ঞা করেছে তখনই মোরগ নিয়ম করে দু’বার ডেকেছে। সে রেগে গজগজ করতে করতে বলল–দুষ্টু মোরগটা জাহান্নামে যাক। আমার সেদিন থাকলে আমার সেই শক্ত বর্শাটা নিয়ে ব্যাটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এমন চিৎকার করাতাম যে মনে হত ব্যাটা মরণ আর্তনাদ করছে।
পরের দিন ভূতটি বেশ দুর্বল আর ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বিগত চারটি সপ্তাহে ভয়ঙ্কর উত্তেজনার ফল ফলতে শুরু করল। একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে গেল তার স্নায়ুগুলি। সামান্য একটু শব্দেই সে চমকে উঠতে লাগল। পাঁচটি দিন সে ঘরের মধ্যে বসে বইল; তারপরে ঠিক করল লাইব্রেরি। ঘরের মেঝেতে আর সে সেই রক্তচিহ্নটি বসিয়ে আসবে না। ওটিস-এর পরিবারবর্গ ওটা যদি পছন্দ না করে স্পষ্টতই ও-জিনিসটি না দেখার অধিকার তাদের রয়েছে। মনে হয় ওরা নীচু বাস্তব স্তরের মানুষ। ইন্দ্রিযড ঘটনার যে একটা সাংকেতিক মূল্য রয়েছে তা হৃদয়ঙ্গম করতে ওরা অক্ষম সপ্তাহে একবার আবির্ভাব হওয়া আর মাসের প্রতি প্রথম আর তৃতীয় শুক্রবার। ডানালার পাশে গিয়ে মুখ ভেঙানোই তার প্রধান কাজ। সে বুঝতে পারল না এই কর্তব্যে সে অবহেলা করবে কেমন করে? কথাটা সত্যি যে তার জীবনটা বড়ো নোংরা ছিল; কিন্তু আবার অন্য দিক থেকে কিছু অতি প্রাকৃতের সঙ্গে জড়িত তাদের সম্বন্ধে তার বিবেকটা ছিল বড়ো সজাগ। সেই জন্যে পরের তিনটি শনিবার যথারীতি সে বারান্দায় বেরিয়েছিল, কিন্তু কেউ তাকে দেখতে অথবা তার পায়ের শব্দ শুনতে যা পায় সে বিষয়ে সে খুব সতর্ক ছিল। এই উদ্দেশ্যে সে বুট খুলে ফেলল, ঘুণ-ধরা কাঠের তক্তার উপরে খুব আস্তে আস্তে হাঁটল, বেশ বড়ো কালো একটা ভেলভেটের আলখাল্লায় নিজেকে রাখল ঢেকে, আর শেকলগুলোকে মসৃণ। করার জন্যে, যদিও এটা করতে তার খুবই কষ্ট হয়েছিল, তবুও সে ‘রাইসিং সান লিউব্রিকেটর’ ব্যবহার করল। একাজ করতে প্রথমে সে অপমানবোধ করেছিলকিন্তু এই তেলের উপকারিতা বোঝার মতো জ্ঞান তার হয়েছিল। এতসব করার পরেও বারবার তাকে অপদস্ত হতে হল। প্রায় বারান্দার ওপরে দড়ি বেঁধে রাখত তারা। তার ফলে অন্ধকারে তাকে লাফিয়ে চলতে হত। একবার যমজ ভাই দুটি এমন এক কৌশল করেছিল যার ফলে তাকে ভীষণভাবে পড়ে যেতে হয়েছিল। এই শেষ অপমানটি তার এত বেশি লেগেছিল যে সে ঠিক করল–আব না, এবার তার লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্যে তাকে একবার শেষ চেষ্টা করতে হবে। সে ঠিক করে ফেলুল পরের রাত্রিতে ‘রেকলেস রুপার্ট’ অথবা ‘দ্য হেডলেস। আর্ল’-এর যে বিখ্যাত ভূমিকায় সে অভিনয় করেছিল সেই বেশে ইটন-এ পড়া ওই দুটি উদ্ধত যুবককে একটা চরম শাস্তি সে দেবে।