ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হতে না হতেই মিঃ ওয়াট সত্যি সত্যিই লাফিয়ে উঠলেন আর অপুর্ব দক্ষতার সঙ্গে জাহাজ থেকে ঝুলতে থাকা একটা দড়ি ধরে ফেললেন। ওই দড়িটা জাহাজের একটা মোটা শেকলের সঙ্গে বাঁধা ছিল। পর মুহূর্তেই তিনি জাহাজে উঠে গিয়ে তাঁর কামরার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
এদিকে আমাদের ছোট নৌকোটার অবস্থা কাহিল। ওটা সমুদ্রের দয়ার ওপর তখন পুরোপুরি নির্ভরশীল একটা পালকের মতো নগণ্য জিনিসমাত্র। যাই হোক প্রাণপণ চেষ্টা করে আমরা নৌকোটাকে সামলে নিলাম আর বুঝতে পারলাম যে মিঃ ওয়াটের ভাগ্য মন্দ।
জাহাজ থেকে আমাদের নৌকোটার দূরত্ব তখন বেড়েই চলেছে। হঠাৎ দেখা গেল ওটার ডেকের ওপর তার চারকোনা বাক্সটাকে টানতে টানতে এনে দাঁড়িয়েছেন ওয়াট। দূর থেকে জাহাজের পাটাতনের ওপর তার চেহারাটাকে খুব বড় দেখাচ্ছিল। আমাদের বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে দেখা গেল উনি তিন ইঞ্চি মোটা একটা দড়ির কয়েকপাক বাক্সটায় দিয়ে নিয়ে তারপর নিজের শরীরেও জড়ালেন সেটা। তারপর মুহূর্তেই বাক্সসহ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওয়াট আর চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন।
আমাদের কারো মুখে কথা ছিল না। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা নৌকোটার মধ্যে বসে থেকে ঠিক যেখানটায় মিঃ ওয়াট ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেইদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেকের মত সময় নির্বাক অবস্থায় কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত সেই কঠোর নীরবতা ভঙ্গ করলাম আমি। বললাম, আচ্ছা আপনি লক্ষ্য করেছেন ক্যাপ্টেন, কত দ্রুতবেগে ওয়াট তার বাক্স নিয়ে জলের তলায় ডুবে গেলেন? ব্যাপারটা একটু অসম্ভব মনে হচ্ছে না? বাক্সের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে নিয়ে উনি যখন ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তখন কিন্তু আমি আশা করেছিলাম অন্য রকম।
ক্যাপ্টেন উত্তর দিলেন, “উনি ডুবে গেলেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই। প্রায় একটা ভারী গোলার মত। তবে উনি আবার ভেসে উঠবেন–কিন্তু যতক্ষণ নুনটা গলে না যাচ্ছে ততক্ষণ নয়।
‘নুন?’–আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
‘না, এখন নয়,–মিঃ ওয়াটের স্ত্রী আর বোনেদের দেখিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘পরে কোন এক সময় এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
.
খুব বিপদের ভেতর দিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত নিয়তির কৃপায় আমরা তীরে গিয়ে পৌঁছলাম আর আগের নৌকোয় যারা এসেছিলেন তাদের সঙ্গে মিলিত হলাম। অবশ্য আমাদের অবস্থা মৃতপ্রায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চারদিনের দিন আমরা পৌঁছেছিলাম রোনোক দ্বীপের বিপরীত দিকের তটভূমিতে। এখানে আমরা সবাই ভালো ব্যবহার পেয়েছিলাম। প্রায় সপ্তাহখানেক এখানে কাটিয়ে, আমরা নিউইয়র্ক রওনা হয়ে গেলাম।
.
‘ইণ্ডিপেণ্ডেন্স’ ডুবে যাবার প্রায় একমাস পরে একদিন ব্রডওয়েতে ক্যাপ্টেন হার্ডির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বলা বাহুল্য আমাদের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো জাহাজডুবি আর হতভাগ্য মিঃ ওয়াটের শেষ অবস্থা। ঐ আলোচনাসূত্রেই পুরো খবরটি আমি পেয়েছিলাম।
শিল্পীটি নিজের, স্ত্রীর, দুই বোনের আর একজন চাকরের জন্য জাহাজে জায়গা সংগ্রহ করেছিলেন। আগে যেভাবে বলা হয়েছে ওঁর স্ত্রী ছিলেন অসামান্যা রূপসী। যে চোদ্দ তারিখে আমি প্রথম জাহাজে গিয়েছিলাম সে দিনই ওয়াটের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন আর মারা যান। যুবক স্বামী প্রায় উন্মাদ হয়ে যান কিন্তু নানা কারণে নিউইয়র্ক যাত্রা করার দিন বেশী পিছোনো সম্ভব হয় নি। মায়ের কাছে স্ত্রীর মৃতদেহটি নিয়ে যাওয়া দরকার অথচ সাধারণ ভাবে তা নিয়ে যাওয়া সংস্কারে বাধে। মৃতদেহ জাহাজে তুললে সব যাত্রীই নেমে পালাবে।
এ সমস্যার সমাধান ক্যাপ্টেন হার্ডিই করেন। উনিই পরামর্শ দেন যে মৃতদেহটায় ওষুধপত্র মাখিয়ে যথেষ্ট নুনের মধ্যে একটা প্রয়োজনীয় আকারের বাক্সে পুরে, সাধারণ মালপত্র হিসেবে জাহাজে তোলা যেতে পারে। ভদ্রমহিলার মৃত্যু সম্পর্কে কোন কথা বলারই প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু মিসেস ওয়াট হিসেবে কাউকে যাত্রী নেওয়ার প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। মৃত স্ত্রীর পরিচারিকাকে ঐ ভূমিকায় নেওয়া সহজেই সম্ভব হয়েছিল। আগে মিসেস ওয়াটের জীবৎকালে যে কামরাটি এই পরিচারিকার জন্যে ভাড়া করা হয়েছিল সেইটেই তার জন্যে রয়ে গেল। এই পরিচারিকা রাত্রিতে ওই কামরায় ঘুমোত আর ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই এই তথাকথিত পত্নীটি তার ভূমিকায় যথাযথ ভাবে কর্তব্য পালনের চেষ্টা করত। একটা সুবিধে ছিল এই যে যাত্রীদের কেউই মিসেস ওয়াটকে চিনতেন না।
আমার ত্রুটি সম্পর্কে এবার আমি সচেতন হয়ে উঠলাম। বুঝতে পারলাম যে আমি শুধু অসতর্কই যে হয়েছিলাম তাই নয়, বড় বেশী কৌতূহলী হয়ে অন্ধ আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলাম। ইদানীং কিন্তু আমার ঘুম ভালোই হচ্ছে। কখনো কখনো শুধু একটা মুখের ছায়া আমার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে আর চিরদিনই বোধহয় একটা উন্মত্ত অট্টহাস্য আমি একাই শুনতে পাব।
.
৭. এমোনটিল্লাভোর পিপে
ফর্চুনাটো ক্ষতি করেছে আমার অজস্র আর সব কিছু আমি হাসিমুখেই সহ্য করেছি। সে কিন্তু যেদিন আমাকে অপমান করতে সাহসী হয়ে উঠল সেই দিনই প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি প্রতিশোধ নেবো। যারা আমাকে ভালো করে চেনে তারা জানে মনের কোন কথাই আমি মুখে প্রকাশ করিনে। যাই হোক প্রতিশোধ যে আমি নেবোই এতে কোন সন্দেহ রইল না যদিও এ ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করতে গেলে যে ঝুঁকির প্রশ্ন আছে তা আমি বিস্মৃত হলাম না। আমার তাই সিদ্ধান্ত ছিল এই যে প্রতিশোধ আমি নেবো কিন্তু তার জন্য কোন শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হবে না। প্রতিশোধ যে নিতে চায় সে যদি নিজেই হারিয়ে যায় তা হলে অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া অন্যায় যে করেছে প্রতিশোধ নেবার বেলায় সে যদি প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে অবহিত না হয়, তাহলেও প্রতিশোধস্পৃহা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।