কাঠের বাক্সটা ছিল প্রায় ছ’ফুট লম্বা আর আড়াই ফুট চওড়া। ওটাকেই আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। ওটার মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য আছে মনে হল আমার। আমার অনুমানের মধ্যে কোন ত্রুটি ছিল না। এবার মনে হোল বন্ধুর বাড়তি এই বাক্সটির মধ্যে একটা বা অনেকগুলো ছবি আছে। আমি জানতাম, কয়েক সপ্তাহ ধরে বন্ধুটি নিকোলিনোর সঙ্গে কি সব আলোচনা করছিলেন। এ বাক্সটা দেখে তাই মনে হয় এতে লিওনার্দোর লাস্ট সাপার ছবির প্রতিলিপি আছে। আমি জানি ফ্লোরেন্সের ছোট-রুবিনির আঁকা এমনি একটা প্রতিলিপি দীর্ঘদিন নিকোলিনোর কাছে ছিল । এ বিষয়ে তাই আমার কোন সন্দেহই রইল না। নিজের সূক্ষ্ম বিচার বুদ্ধির ওপর বেশ খানিকটা শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। কিন্তু এত বড় একটা শিল্পকর্ম সম্পর্কে ওয়াট আমাকে কিছুই জানাতে চাননা কেন? নিশ্চয় আমার অজ্ঞাতসারেই বস্তুটাকে গুপ্তভাবে নিউইয়র্কে পাচার করতে চান। আমিও স্থির করলাম এ নিয়ে বেশ মজা করব ওর সঙ্গে একটা ব্যাপার লক্ষ করে খুব বিরক্ত বোধ করলাম। বাক্সটাকে ওঁরা বাড়তি কামরায় না পাঠিয়ে নিজের কামরায় রাখলেন। ওটা ঘরের পুরো মেঝে দখল করে রইল আর বলাই বাহুল্য যে এতে মিঃ ওয়াট আর তাঁর স্ত্রী উভয়ের অবশ্যই অসুবিধে হচ্ছিল। তাছাড়া বক্সিটার ওপর যে রঙ দিয়ে বড় বড় হরফে ঠিকানা লেখা হয়েছিল তা থেকে বিশ্রী এক ধরনের গন্ধও বেরুচ্ছিল। বাক্সের ঢাকনার ওপর লেখা ছিল,–’মিসেস এডেলাইড কার্টিস, আলবানি, নিউইয়র্ক। প্রেরক–মিঃ কর্ণেলিয়াস ওয়াট। এই দিকটি উপরে রাখুন। সাবধানে নড়াবেন। এখন বুঝলাম ঐ মিসেস এডেলাইড কার্টিস মিঃ ওয়াটের শাশুড়ী। কিন্তু ঠিকানাটায় যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেলাম। আমি জানতাম যে ওই বাক্স বন্ধুর নিউইয়র্ক শহরে চেম্বার্স স্ট্রীটে যে স্টুডিও আছে তা থেকে উত্তর দিকে কখনোই যাবে না।
প্রথম তিন চার দিনে আমরা উপকুল ছাড়িয়ে সমুদ্রের মধ্যে অনেকখানি উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছিলাম। আবহাওয়াও বেশ শান্ত ছিল তখন।
জাহাজের আরোহীদের মন মেজাজ তখন বেশ ভালোই ছিল আর সবাই সবার সঙ্গে বেশ সামাজিক ব্যবহার করে চলেছিল। কিন্তু এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলব যে মিঃ ওয়াট আর তার বোনেরা মোটেই ভালো ব্যবহার করছিলেন না। বরং বলব ওঁরা যাত্রীদের সঙ্গে অভদ্র আচরণই করছিলেন। ওয়াটের ব্যবহারের জন্য আমার কোন মাথাব্যথা ছিল না। উনি মুখ গোমড়া করেই ছিলেন আর ঐটেই তার স্বভাব। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ওঁর বিষণ্ণতাকে আমি বিশেষ চারিত্রিক লক্ষণ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু তার বোনদের আমি ক্ষমা করতে পারছিলাম না। অধিকাংশ সময়ই ওরা ওদের ঘরের মধ্যে থাকছিল। আমি বহুবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোন যাত্রীর সঙ্গে মেলামেশায় ওরা রাজী হয়নি।
মিসেস ওয়াটের ব্যবহার কিন্তু খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। উনি সকলেরই সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। মাঝ-দরিয়ায় এইভাবে সকলের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর মূল্য অনেকখানি। আমার মনে হোল উনি নারী আর পুরুষদের সঙ্গে বেশ হৃদ্যতার সঙ্গেই মিশছিলেন। খুব আনন্দ দিচ্ছিলেন তিনি সবাইকে। হ্যাঁ, আনন্দ দিচ্ছিলেন বলা ছাড়া আর কীইবা বলতে পারি। আমি আবিষ্কার করলাম তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা হচ্ছে না বরং সব হাসিঠাট্টায় তিনি খোলাখুলি ভাবে যোগ দিচ্ছেন। পুরুষেরা ওঁর সম্পর্কে প্রায় নীরবই ছিলেন কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই নারীরা ঘোষণা করলেন যে মহিলাটি দেখতে সুন্দরী ত নয়ই, তিনি অশিক্ষিতা আর আন্তরিকতা থাকলেও রুচির দিক থেকে অত্যন্ত অমার্জিত। এই মহিলা কী ভাবে ওয়াটকে কাঁদে ফেললেন আর বিয়েতে রাজী করালেন সেইটি আমার কাছে একটা রহস্য হয়ে দাঁড়ালো। অর্থ অবশ্যই একটা সাধারণ সমাধান সূত্র। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি কেননা মিঃ ওয়াট আমাকে আগেই বলেছেন যে উনি সঙ্গে করে একটা ডলারও আনেন নি বা ভবিষ্যতে যে কোথাও থেকে কিছু পাওয়া যাবে এমন সম্ভাবনার পথও দেখান নি। ওয়াট বলেছিলেন যে শুধু ভালোবেসেই নাকি উনি এঁকে বিয়ে করেছেন আর সেদিক থেকে ইনি অতুলনীয়া। বন্ধুর কাছ থেকে শোনা এই সব কথা যখন মনে পড়ল তখন আগাগোড়া ব্যাপারটাই আমার কাছে পরম রহস্যময় হয়ে উঠল। তবে কি ভদ্রমহিলার সংস্পর্শে আসার সময় ওঁর ইন্দ্রিয়গুলো ক্রিয়াশীল ছিল না। যে মানুষ এতখানি মার্জিতরুচিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, বিচারশীল, সৌন্দর্য সম্পর্কে এত বেশী সচেতন মানুষের পক্ষে বিশেষ করে ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে এমন অসহিষ্ণু মানুষের পক্ষে এ কী করে সম্ভব। তবে এ কথা ঠিক যে ভদ্রমহিলা তার স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে এই ভালোবাসা বড় বেশী পরিমাণেই প্রকাশিত হোত। সে সময় উনি কথাবার্তার মধ্যে প্রায়ই স্বামীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলতেন, আমার প্রিয়তম স্বামী মিঃ ওয়াট কিন্তু এই রকমই বলেন। স্বামী শব্দটা তো তাঁর জিভের ডগায় লেগেই থাকত। বলা বাহুল্য এই উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে উল্লিখিত কথাগুলোও তাঁরই। জাহাজের সব যাত্রীই কিন্তু এটা লক্ষ্য করেছিলেন যে মিঃ ওয়াট কিন্তু স্ত্রীকে বেশ এড়িয়ে চলছেন। স্ত্রীকে অবাধে-সকলের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ দিয়ে উনি ওঁর কামরার মধ্যে অধিকাংশ সময় একাই কাটিয়ে দিচ্ছিলেন।