মাথা গুলিয়ে গেল। পেটের ভিতরে আতঙ্ক বাসা বাঁধছে। আমার মনে হয় পুলিশে ধরা দেয়া উচিত।
কারণ আমি হয়তো সত্যিকারের কিশোর পাশা নই। আমি হয়তো অন্য কেউ। আমি হয়তো মি. লাউয়ির বর্ণনা করা সেই ছেলেটির মত, চেষ্টা করছি আমি নই এমন কারও ভূমিকা নিতে।
কিন্তু তা-ই যদি হবে, তবে আজ সকালে নিজের বাসায় আমার ঘুম ভাঙল কীভাবে? এবং কেউ আমাকে না চিনলেও আমি সবাইকে চিনছি কী করে?
সবচাইতে বেশি ভয় লাগছে, এখন আর এটাকে নিছক তামাশা মনে করতে পারছি না। ব্যাপারটা তার চাইতে অনেক জটিল আর বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
আমি কে প্রমাণ করার নিশ্চয়ই কোন উপায় আছে। স্কুলে লাভ হবে না। হাসপাতালেও না। কোথায় যাব আমি?
বাসায় যাব! জোরে বলে উঠলাম। বাসায় চাচা-চাচীর সঙ্গে আমার প্রচুর ছবি রয়েছে। বই রয়েছে যাতে আমার নাম লেখা। প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট, আমি কে।
ঘড়ি দেখলাম। ১:৩০। চাচা-চাচী আরও কয়েক ঘণ্টা বাইরে থাকবে। নিশ্চয়ই ডনকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। মেইন স্ট্রীট ধরে বাসার দিকে হেঁটে চললাম।
আকাশ হঠাৎই গোলাপী হয়ে গেল। সব কিছু যেন কাঁপছে, এবং কোথায় যেন জোরাল বাজনা শুরু হলো। অদ্ভুত বাজনা, রেডিওতে এমনটা বাজে না।
এক দোকানের সামনে টলতে টলতে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেইন স্ট্রীটে আমি ছাড়া কেউ নেই! দু মুহূর্ত পর পর রং বদলাচ্ছে আকাশের। গোলাপী, হলুদ, কমলা, নীল, গোলাপী।
প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলো কাঁধে। দোকানের জানালার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। সাহায্য আশা করছি। জানালায় চোখ রাখলাম। চকচকে কালো পোশাক পরে, জানালায় দাঁড়িয়ে, আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসছেন-মিস লি!
৮
কী চান? কে আপনি? চেঁচিয়ে উঠলাম।
এবং হঠাই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এল। মেইন স্ট্রীট আবারও নিজের নির্জন রূপ ফিরে পেল।
ঘুরে জানালাটার দিকে চাইলাম, আমি যেখানে মিস লিকে দেখেছি কিংবা কল্পনা করেছি। এটা নতুন এক চাইনিজ রেস্তোরা, কম দামে ভাল ফাস্ট ফুড পরিবেশনের জন্য নাম কামাতে শুরু করেছে।
মিস লিকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার জানালা দেখে অনুমান করা যায় এখনও খোলেনি রেস্তোরাঁটা।
রাস্তার দিকে চাইলাম। আমার দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে রকি বীচ পুলিশের এক গাড়ি। হাসপাতালের ঘটনাটার পর সার্জেন্ট কলিন্স হয়তো আমাকে খুঁজছেন।
কেটে পড়ব সিদ্ধান্ত নিলাম।
এক গলিতে সাত করে ঢুকে পড়ে মেইন স্ট্রীটের পিছনের গাছগাছালির উদ্দেশে দৌড় দিলাম। মাঠ পেরিয়ে পৌঁছতে হবে বাসায়।
লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে এভাবে গেলে। কাঁধের ব্যথায় মরে যাচ্ছি, এবং খিদেও মরে গেছে। কিন্তু কলিন্সকে এড়াতে হলে এটাই নিরাপদ রাস্তা।
দশ মিনিট বাদে বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে প্রতিবেশীদের কাউকে দেখতে পেলাম না।
সদর দরজার চাবি ঢোকাতে যাব, এসময় পাশের বাসার মিসেস বার্টন দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হাতে প্লাস্টিকের ময়লা ভরা ব্যাগ।
হাই, মিসেস বার্টন? খোশমেজাজে ডেকে উঠলাম। স্কুল থেকে কেন আগে বাড়ি ফিরেছি তার কারণ জানানোর জন্য মাথা খেলালাম।
কিন্তু এবার ওঁর মুখের চেহারায় যে দৃষ্টি ফুটল সেটি গত কঘন্টা ধরে দেখে আসছি আমি। উনি আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ভ্রূ কুঁচকালেন।
আহ, হ্যালো, বললেন তিনি, কণ্ঠে বিস্ময়। আমি তোমাকে চিনি?
কী বলব জানি না। আমরা কি কোন খেলা খেলছি? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? নাকি অন্য কিছু? কীভাবে জবাব দেব ওঁকে?
আমি অন্য পথ ধরলাম।
আমি পাশা পরিবারের পরিচিত, বললাম। ওঁরা আমাকে এখান থেকে কিছু জিনিস নিয়ে যেতে বলেছেন।
এর বেশি সে মুহূর্তে আর কিছু মাথায় এল না। গত কঘণ্টার কথা ভাবলে, আমি যে আদৌ চিন্তা করতে পারছি সেটাই এক বিস্ময়।
ওহ, বললেন তিনি, তবে তাকে খুব একটা সন্তুষ্ট মনে হলো না। ডিসপোসাল বিনের দিকে হাঁটতে শুরু করে হঠাৎই ঘুরে দাঁড়ালেন। আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন। আচ্ছা, তুমি আমার নাম জানলে কীভাবে?
দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাঁর দিকে চেয়ে রইলাম। আমার চোখ মরিয়ার মত একটা জবাব খুঁজছে। ওঁদের মেইলবক্স দেখতে পেলাম। ওটার দিকে তর্জনী নির্দেশ করলাম।
আপনার নাম ওখানে আছে। বার্টন। তাই ভাবলাম আপনিই তিনি।
বক্সের দিকে দুমুহূর্ত চেয়ে থেকে আমার দিকে চাইলেন তিনি। মাথা ঝাঁকিয়ে ঈষৎ হাসলেন। এবার বিনে ব্যাগটা ফেলে সোজা বাসায় ঢুকে পড়লেন।
আমি শ্বাস নিয়ে, চাবিটা তালায় ঢুকালাম। ঘুরালাম। খুলল না। আমার চাবিতে সদর দরজা খুলছে না। এ কীভাবে সম্ভব? সব সময় খুলেছে, কিন্তু এখন খুলছে না কেন?
চাচা-চাচী কি আমাকে ঢুকতে না দেয়ার জন্য তালা পাল্টেছে? সেটা কি সম্ভব? নাকি আমি যে নিজের বাসায় একজন আগন্তুক এটা তার আরেকটা উদাহরণ?
আমাকে বাসায় ঢুকতে হবে। ওখানে আমার প্রশ্নের জবাব রয়েছে। জানালা ভাঙা সম্ভব নয়। মিসেস বার্টন টের পেয়ে পুলিস ডাকবেন।
জানালা! হ্যাঁ, বেসমেন্টের জানালাটা গত ছমাস ধরে ভাঙা চাচা ঠিক করতে চেয়েছিল, কিন্তু করা হয়নি। আশা করছি ওটা এখনও ওভাবেই রয়েছে।
বাড়ির পিছনে দৌড়ে গেলাম। জানালাটা এখনও ভাঙা, ভিতরে ঢুকতে বেশ কষ্টই হবে, তবে ঢোকা যাবে। একটু পরে শরীর গলিয়ে দিয়ে বেসমেন্টে লাফিয়ে নামলাম।