হাসো, হাসো! চেঁচিয়ে উঠলাম, চোখ জ্বালা করছে অনুভব করলাম। কে তোমাদের চায়! দৌড় দেয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম।
শোনো, মিস লি মৃদু কণ্ঠে বললেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দিকে চাইলাম।
বলুন।
আজকে নিজেকে তোমার একদম নতুন মানুষ মনে হচ্ছে, তাই না?
বিস্মিত হলাম। দ্রমহিলা কী বলছেন জিজ্ঞেস করতে চাইলাম। কিন্তু উনি মুহূর্তের জন্য আমার দিকে চেয়ে হাসলেন। এবং তারপর, যেন বাতাসের ধাক্কায়, ক্লাসরুমের দরজাটা দড়াম করে লেগে গেল আমার মুখের উপর। হলওয়েতে একাকী দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।
ওই যে ও! আমার উদ্দেশে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। ঘুরে চাইলাম। দারোয়ান আমাকে দেখে ফেলেছে। হঠাৎই সে আর মি. লাউয়ি দৌড়ে আসতে লাগল আমার দিকে। আমাকে পালাতে হবে!
৪
আমি ওদের চাইতে সিঁড়ির কাছাকাছি, তাই এক দৌড়ে দুটো করে ধাপ ভেঙে উঠে গেলাম। একটু পরেই মেইন ফ্লোরে ফিরে এলাম।
মুহূর্তের মধ্যে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
ফিরে এসো! আমরা তোমাকে কিছু করব না, আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই! মি. লাউয়ি আমার উদ্দেশে চেঁচালেন। স্কুল এন্ট্রান্সের সবচাইতে উঁচু ধাপে দাঁড়িয়ে তিনি, চেয়ে রয়েছেন আমার দিকে।
আমি এখন রাস্তার দিকে হাঁটা দিয়েছি। স্কুলের খেলার মাঠ পেরিয়ে গেছি, কাজেই ওরা কার্যত আমাকে আর ধরতে পারে না।
আপনাদের কাছ থেকে আমি আর সাহায্য চাই না! পাল্টা চেঁচালাম। সাহায্য করতে চাইলে আপনারা এই তামাশাটা বন্ধ করতেন! ব্যাপারটা হয়তো আপনাদের কাছে মজার কিন্তু আমার কাছে!
কীসের তামাশা? বললেন মি. লাউয়ি। সত্যি বলছি তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।
ওঁর মুখের চেহারা আর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত আন্তরিক। উনি কি অন্যদের মত অভিনয় করছেন? আমাকে যেটা খোচাচ্ছে…যদি ওটা অভিনয় না হয়? সত্যিই যদি ওঁরা আমাকে না চেনেন! কিন্তু সেটা তো অসম্ভব…তাই না?
ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিলাম মেইন স্ট্রীটের দিকে। একটু পরে শ্বাস ফিরে পেতে থামলাম। দস্তুরমত হাঁফাচ্ছি।
কাঁধ ডললাম। ভীষণ ব্যথা করছে এমুহুর্তে। মিস লি-র কথা ভাবলাম। ওঁর মধ্যে কী যেন আছে যেটা খুব পরিচিত লেগেছে। তার কথা যত বেশি ভাবছি কাঁধের ব্যথাটাও বাড়ছে। ওঁকে আগে অন্য কোথাও দেখেছি…কিন্তু কোথায়?…কোথায়?
হা-হা-হা-হা! আমার কানে কার যেন জোরাল খলখল হাসি বাজল। এতটাই চমকেছি, পড়েই যাচ্ছিলাম প্রায়। ঘুরে দাঁড়ালাম।
সরাসরি চোখাচোখি হলো ম্যাকের সঙ্গে।
ম্যাক ভবঘুরে ধরনের লোক। কারও ক্ষতি করে না, কিন্তু ওকে দেখলে আমার ভয়-ভয় করে।
কী, ছেলে, স্কুল পালিয়েছ, না? সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল ও। চোখজোড়া লাল। কতদিন গোসল করে না কে জানে। পরনের কাপড়চোপড় ময়লা।
ন-না, তুতলে বললাম। আমি…আহ….
আমার কণ্ঠ মিলিয়ে গেল। মিথ্যে ভাল বলতে পারি না আমি। আর সত্যি কথাটা হচ্ছে, আমি তো আসলেই স্কুল পালাচ্ছি।
কোন চিন্তা নেই, আমি কাউকে বলব না, ম্যাক অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল। একটা বাদামি ব্যাগ বাড়িয়ে দিল। ভিতরে খাবার-টাবার কিছু আছে। টেস্ট করবে?
না! বলে এক পা পিছু হটলাম। ঘুরে দাঁড়ালাম। এর কাছ থেকে পালাতে চাই।
এই দুনিয়ায় সবচাইতে কঠিন ব্যাপার কি জাননা? প্রশ্ন করল ম্যাক। হঠাৎই পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কণ্ঠস্বর। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চাইলাম। ওর চোখজোড়া যেন দীপ্তি ছড়াচ্ছে, দেহ কাঁপছে।
না, কী? প্রশ্ন করলাম।
আমরা আসলে কে সেটা জানা। হ্যাঁ, এটাই। তুমি কি জাননা তুমি আসলে কে? বলে জানো? পাগলের মত হাসতে লাগল আবার ও।
এবং আচমকাই দেখতে পেলাম আমি আর ম্যাকের দিকে চেয়ে নেই। ও মিস লি হয়ে গেছে! তিনি ম্যাকের হেঁড়াখোড়া পোশাক পরে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন!
কাঁধের ব্যথাটার কী অবস্থা, কিশোর? নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন। স্মিত হাসলেন আমার দিকে চেয়ে। আশা করি শীঘ্রি তোমার ব্যথা কমে যাবে।
মৃদু শব্দে হাসতে লাগলেন তিনি। এবার আমি আবার ম্যাকের মুখের দিকে চেয়ে! হাসছে, কাশছে-ওর মুখের চেহারা টকটকে লাল। হাসতে হাসতে আমার দিকে তর্জনী নির্দেশ করছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিলাম। কোথায় যাচ্ছি নিজেও জানি না। মেইন স্ট্রীটের সামনে গাছ-পালায় ঘেরা এক টুকরো জমি আর তারপর খোলা মাঠ। সেখানে দৌড়ে চলে গেলাম। কেউ দেখতে পাচ্ছে না নিশ্চিত না হওয়া অবধি ছুটে চললাম।
খোলা মাঠের কাছে এক জায়গায় এসে পৌঁছলাম। প্রকাণ্ড এক গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ে চোখ বুজলাম। কতক্ষণ ওখানে ছিলাম জানি না, আচমকা চটকা ভেঙে গেল।
ঘড়ি দেখলাম। ১১:৩৫! নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চোখ ঘষলাম। আউ! কাঁধের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ব্যথার জায়গাটায় হাত বুলিয়ে চারধারে নজর বুলালাম।
দৃষ্টিসীমার মধ্যে কেউ নেই। শুধু বিশাল, ফাঁকা মাঠটা-বাঁ দিকে গাছ-পালার দঙ্গল আর তার পিছনে মেইন স্ট্রীট।
পেটের ভিতরে গুড়-গুড় করে উঠল। সকালে নাস্তা খাইনি এবং এখন প্রায় লাঞ্চের সময়। এতসব অদ্ভুত ঘটনার মধ্য দিয়ে গেলেও খিদে ঠিকই পেয়েছে আমার। কিছু খাওয়া দরকার।
উঠে দাঁড়ালাম। পেটে কিছু গেলে হয়তোবা এই রহস্যের সমাধান খুঁজে পাব। হয়তো সব কিছুই এখন ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আমি স্কুলে ফিরে গেলে হয়তো সবাই আমাকে চিনতে পারবে। আর কোন সমস্যা হয়তো থাকবে না!