এক ছুটে ফোনের কাছে গিয়ে ৯১১ ডায়াল করলাম। বাসার ঠিকানায় তখুনি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বললাম। এবার দৌড়ে উপরে গিয়ে, একটা বালিশ খুঁজে নিয়ে নেমে এলাম। মিসেস ওয়েসলির মাথার তলায় খুঁজে দিলাম ওটা।
মহিলার চোখ বোজা। শ্বাস-প্রশ্বাস অনিয়মিত। দূরাগত অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন কানে এল, নিশ্চিত হলাম মিসেস ওয়েসলি শীঘি চিকিৎসা সেবা পাবে।
কিন্তু ওরা যখন আসবে তখন আমার থাকা চলবে না। আমাকে চলে যেতে হবে।
সদর দরজা খুলে দুদ্দাড় করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাস্তা ধরে দৌড় দিলাম। অপর দিক থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সের পাশ কাটালাম।
মিসেস ওয়েসলির যত্ন নিয়েন, বললাম, সাইরেনের শব্দে চাপা পড়ে গেল আমার কথাগুলো উপলব্ধি করলাম এটা অনেকটা প্রার্থনার মত শুনিয়েছে।
রাস্তা ধরে দৌড়চ্ছি, এটা গিয়ে মিশেছে মেইন স্ট্রীটে। আর কোথায় যাব জানি না আমি, কী করব তাও জানা নেই।
স্কুলের ফুটবল মাঠের দিকে এগোলাম। আমার কজন টিমমেট, তাদের মধ্যে রব মিশেলও রয়েছে, প্রি-প্র্যাকটিস ক্যাচ করছে।
ওদেরকে দেখার জন্য থেমে দাঁড়ালাম। হঠাৎই ওদের একজন দেখতে পেল আমাকে। ওরা খেলা থামিয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। রব আমার দিকে আঙুল তাক করল। ও কিছু একটা বলতেই হেসে উঠল সবাই।
সেই পাগলটা, হয়তো এটাই বলেছে।
মেইন স্ট্রীটের দিকে দৌড়ে চললাম। জানি না কেন। কিন্তু কিছু একটা ওদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম জোরে ছুটছি না, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি না, কিন্তু দুগাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে।
একটু পরেই টের পেলাম ওটা ঘাম না, অশ্রু।
আমি কাঁদছি এবং সেজন্য লজ্জাও পাচ্ছি না। কাঁদছি কারণ আমার সঙ্গে যে এই মস্ত রসিকতাটা করেছে সে জিতে গেছে। কিংবা কেউ হয়তো কিছু করেনি। আমি নিজেই হয়তো কাজটা করেছি।
আমি হয়তো আমার পাপের শাস্তি পাচ্ছি। কিন্তু কী করেছি আমি? এবং এর শেষ কোথায়? আমি যে আর সইতে পারছি না।
সামনেই মেইন স্ট্রীট। একটু পরেই শেষ ঘণ্টা বাজবে এবং স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। শদুয়েক ছেলে-মেয়ে বেরিয়ে আসবে হাসতে হাসতে, ছুটতে ছুটতে বাড়ির দিকে যাবে।
কিন্তু আমি কোথায় যাব? আমি যাদেরকে চিনি তারা তো আমাকে চেনে না। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আমার। কোন কিছু আঁকড়ে ধরার উপায় নেই।
আমার হয়তো রকি বীচ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। অন্য কোন শহরে। না, তা হয় না! আমি যেতে চাই না!
আমি আমার পরিবারকে ফেরত চাই। চাই চাচা-চাচী আবার আমাকে ভালবাসুক। আমি চাই ডন যেন আমাকে ভয় না পায়।
আমি চাই বন্ধুরা আমাকে স্বাগত জানাক এবং আমাকে আবার তাদের জীবনের অংশ করে নিক।
আমি বায়োলজি ক্লাসে বসে মি. হালবার্টকে আবারও দেখতে চাই।।
সার্জেন্ট কলিন্সের সঙ্গে আবারও বন্ধুত্বের সম্পর্ক চাই।
আমি চাই ক্যাণ্ডির দোকানে ঢোকার পর বুড়ো জেসাপ জানুক আমার পছন্দের ক্যাণ্ডি কী।
আমি চাই মিসেস ওয়েসলি সুস্থ হয়ে উঠুক।
কিন্তু আমি এ-ও অনুভব করছি একদিনের মধ্যে যদি আত্মপরিচয় প্রমাণ করতে না পারি তবে সার্জেন্ট কলিন্স আমাকে গ্রেপ্তার করাবেন।
মুখ তুলে চাইলাম। লক্ষ করিনি কখন মেইন স্ট্রীট পেরিয়ে শহরের দূর প্রান্তে চলে এসেছি।
চারধারে চোখ বুলালাম। আশপাশে কেউ নেই। না রাস্তায়, না কোন দোকানে।
ব্যাপারটা অদ্ভুত। হঠাৎ করেই চারদিক নির্জন হয়ে গেছে।
এক ঘণ্টাধ্বনির মৃদু শব্দ কানে এল। ঘুরে দাঁড়ালাম। নতুন চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে আসছে। রেস্তোরার জানালার দিকে চেয়ে রয়েছি, ঘণ্টাধ্বনি যেন জোরাল হলো।
টলমল পায়ে মেইন স্ট্রীট পেরিয়ে রেস্তোরাটার দিকে এগোলাম। এখনও কাউকে আশপাশে দেখতে পেলাম না। এমনকী রাস্তা দিয়ে কোন গাড়িও যাচ্ছে না।
এই রেস্তোরাটা আমাকে টানছে কেন? চিন্তাটা মাথায় এল। কেন জানি এটাকে পরিচিত লাগছে। কিন্তু কেন?
ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরব, কানে তালা লাগিয়ে দিল জোরাল ঘণ্টাধ্বনি।
কানে দুহাত চাপা দিয়ে জানালার দিকে চাইলাম-জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসছেন মিস লি! আমাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন তিনি!
১০
চুম্বকের টানে যেন রেস্তোরার জানালায় সেঁটে গেলাম আমি। মিস লি তখনও আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছেন।
কী ব্যাপার! আপনি আমার কাছে কী চান? চেঁচিয়ে উঠলাম।
ঘণ্টাধ্বনি সহসা থেমে গেল। পিনপতন নিস্তব্ধতা। দৃষ্টিসীমার মধ্যে কেউ নেই।
তুমি কেন এখানে এসেছ তুমি জাননা, কিশোর, বললেন মিস লি। অন্তত আমার তাই মনে হলো। আমি ওঁর কণ্ঠ শুনেছি, যদিও ঠোট নড়তে দেখিনি এবং তার হাসি বন্ধ হয়নি এবং কাচের জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি।
কিশোর? আপনি আমাকে কিশোর বললেন? প্রশ্ন করলাম।
সময় হয়েছে, কিশোর, বললেন তিনি। আবারও গলা শুনলাম তার, কিন্তু ঠোট নড়েনি। মৃদু হাসি ধরে রেখেছেন মুখে।
কীসের সময় হয়েছে? প্রশ্ন করলাম। এই খেলা শেষ হওয়ার সময়? নাকি কী ঘটছে তা জানার সময় হয়েছে?
তোমার ভাগ্য জানার সময় হয়েছে, কিশোর।
সাদা এক ন্যাপকিন খুললেন তিনি। ভিতরে এক ফরচুন কুকি। ন্যাপকিনটা ফেলে দিয়ে কুকিটা তুলে ধরলেন মিস লি।।
ওটার দিকে চাইলাম। দুনিয়ার সবখানে চাইনিজ রেস্তোরায় এরকম ফরচুন কুকি দেখা যায়।