প্রথমে কিচেনে ছুটে গিয়ে, নিজের জন্য একটা বেলনি আর পনিরের স্যাণ্ডউইচ বানালাম লেটুস আর সর্ষে দিয়ে, সঙ্গে পান করলাম আধ-কোয়ার্ট দুধ।
নিজের পরিচিত কিচেনে বসে চাচীর খাবার খাচ্ছি, খানিকটা নিরাপত্তা বোধ এল। বাসার তুলনা আর কিছুতে হয় না।
কিচেনের দেয়ালের ছবিটায় চকিত চাউনি বুলালাম। গত সামারে ভােলা। সান্তা মণিকা বীচে চাচী, আমি আর ডন। চাচার তোলা ছবি।
স্যাণ্ডউইচটা মাটিতে ফেলে দিলাম। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের কাছে হেঁটে গেলাম।
ছবিতে চাচী আর ডনকে সৈকতে দেখা যাচ্ছে। আমি নেই। আমি জানি ছবি তোলার সময় আমিও ছিলাম। এতে কোন ভুল নেই। কিন্তু এখন, স্কুলের ফুটবল টিমের ছবিটার মত…আমি স্রেফ উবে গেছি। উধাও।
মাথা ঝিমঝিম করছে। ব্যালান্স বজায় রাখতে দেয়ালে হাত রাখলাম। কাঁদব না আর্তনাদ করব ঠিক করতে পারছি না।
না, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, নিজেকে বললাম। এসবের নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।
যা-ই হোক না কেন, আমাকে এই রহস্যের সমাধান বের করতে হবে।
লিভিং রুমে গেলাম। এখানে দেয়ালগুলো পারিবারিক ছবি দিয়ে ভরা, আমি অনেকগুলো ছবিতে রয়েছি। বাতি জ্বেলে, বিশাল পিছনের দেয়ালের কাছে হেঁটে গেলাম।
ছবিগুলোর দিকে চেয়ে রইলাম। কোনওটাতেই আমি নেই। চাচা আমার অনেক ছবি তুলেছিল। তার মধ্যে ফুটবল জার্সি পরে তোলা ছবিও ছিল। আরও কিছু ছবি ছিল টিমমেটদের সঙ্গে।
গোটা বিভাগটা উধাও। ফুটবলের ছবিগুলোর বদলে ওখানে শোভা পাচ্ছে ডনের পিউই সকার খেলার ছবি। সেইলবোটে চাচীর ছবি। চাচা-চাচী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। আমার কোন ছবি নেই।
আত্মীয়-স্বজন! ডেস্কে রাখা ফোনটার কাছে টলতে টলতে গেলাম। হয়তো শুধুমাত্র রকি বীচে আমার অস্তিত্ব নেই। অন্যান্য জায়গার মানুষ-জন হয়তো আমাকে চেনে।
রিসিভারটা তুলে নিয়ে শিকাগোতে হিরু চাচাকে ফোন করলাম।
হিরন পাশার অফিস, কানে ভেসে এল হিরু চাচার সেক্রেটারি মিস ক্রেনের পরিচিত কণ্ঠস্বর।
মুহূর্তের জন্য থমকালাম। এটা বড় ধরনের পরীক্ষা। হিরু চাচা যদি আমাকে না চেনে, তা হলে কী করব জানি না আমি।
মিস কেন? প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ।
মিস ক্রেন, আমি কিশোর। কিশোর পাশা।
ও প্রান্তে বিরক্তি।
কে?
কিশোর পাশা। হিরন পাশার ভাতিজা…গলা বুজে এল আমার।
ওহ, বললেন তিনি। চিনতে পারলাম না। একটু ধরো, তাঁকে দিচ্ছি।
ভয়ে বুকের ভিতরটা জমে গেল। মিস ক্রেনের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে কথা বলেছি আমি। আর এখন তিনি কিনা আমাকে চিনতে পারছেন না।
মুহূর্ত পরে, হিরু চাচার গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
হ্যালো, হিরন পাশা বলছি। কার সাথে কথা বলছি?
হিরু চাচা? ফিসফিসানির মত শোনাল আমার কণ্ঠ। ভয় পাচ্ছি এরপর না জানি কী শুনব।
কথা বলল, আমি শুনতে পাচ্ছি না, বলল হিরু চাচা। আমি জানি কথা বলা অনর্থক। আমার প্রিয় চাচা আমাকে চিনবে। হয়তো আমার কথা কখনওই শশানেনি। হিরু চাচার মুখ থেকে এ কথা বলে সইতে পারব না আমি।
আমি দুঃখিত, বললাম। আ…আমি মনে হয় রং নম্বরে ফোন করেছি।
ফোন কেটে দিলাম।
কমুহূর্ত নীরবে ডেস্কে বসে রইলাম। এবার আচমকা ঘুষি মারলাম ডেস্ক টপে।
কে আমি? ছাদের উদ্দেশে চেঁচালাম।
কে? কেউ কি বলে দেবে আমাকে? আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে! পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি!
দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ পেলাম। এবার সদর দরজা খুলে যেতে লাগল। কে যেন বাসায় এসেছে।
৯
কে হতে পারে? ঘড়ির দিকে চাইলাম। দুটো বেজে পাঁচ। চাচা-চাচী হতে পারে না। তবে কি ওরা একজন এসে নিশ্চিত হতে চাইছে অচেনা ছেলেটি-আমি-এখানে নেই?
পায়ের শব্দ। প্রথমে মেইন হল-এ, তারপর কিচেনে। কে যেন গুনগুন করছে। গুন-গুন? আজকে বুধবার!
মিসেস ওয়েসলি প্রতি বুধবার আসে অল্প-স্বল্প হাউসকীপিঙের কাজ করতে। কিছুদিন ধরে সে আমাদের হাউসকীপার। মিসেস ওয়েসলি সব সময় গুনগুন করে।
মিসেস ওয়েসলির মত নরম স্বভাবের, ভাল মানুষ দুনিয়ায় কম আছে। অন্যের কষ্ট দেখার চাইতে বরং নিজের হাত কেটে ফেলবে সে।
আমি যদি কোন রসিকতার স্বীকার হয়ে থাকি তবে মিসেস ওয়েসলি হতে পারে তার চূড়ান্ত পরীক্ষা।
দরজার কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে ওটা খুললাম।
মিসেস ওয়েসলির পরনে প্যান্ট, সোয়েটার আর অ্যাপ্রন। প্রকাণ্ড এক ব্যাগ থেকে ক্লিনিং সাপ্লাই বের করছে। পুরানো এক লোকগীতির সুর ভাজছে সে।
আমি তাকে ভয় দেখাতে চাই না। কিন্তু আমি নিজেই ভয় পাচ্ছি। ।
এটা আমার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এক ধরনের বাজি ধরতে হচ্ছে আমাকে।
সাবধানে কিচেনের দিকে এগোলাম। মিসেস ওয়েসলি তার সাপ্লাই বিছিয়ে রাখছে কিচেন টেবিলের উপরে। পুরানো সুরটা গুন-গুন করে চলেছে।
মিসেস ওয়েসলি, মৃদু কণ্ঠে বললাম।
উ করে চেঁচিয়ে উঠে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে। চোখাচোখি হলো আমাদের। মুখের চেহারা স্বাভাবিকের চাইতে লাল হয়ে গেল তার। কিছু বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু হাতজোড়া উঠে এল বুকে।
মিসেস ওয়েসলি! আপনি ঠিক আছেন তো? চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।।
জবাব দিল না সে। সভয়ে আঁতকে উঠে ধপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। তার পাশে দৌড়ে গেলাম। কজি তুলে নিয়ে পালস দেখলাম। দুর্বল আর দ্রুত। মিসেস ওয়েসলির হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং এর জন্য আমি দায়ী!