কিন্তু গতরাতে আমি মায়ানেকড়েটাকে দেখেছি। এর সঙ্গে কোন মিলই নেই।
মায়ানেকড়ে হয়ে যাবার পর মানুষের সঙ্গে আর কোন মিল থাকে না ওদের।
হ্যাঁ, আপনার ছেলে ঠিকই বলছে-আপনি যা ভাবছেন তা আমি নই, মিনতি করে বলল লোটা। আমাকে ছেড়ে দিন।
চুপ! ধমকে উঠল বাবা। তুমি বললেই আমি ছাড়ি! আমাকে গাধা পেয়েছ?
মস্ত ভুল করছেন আপনি! গুঙিয়ে উঠল লোকটা। আমি মায়ানেকড়ে নই। আমার কথা বিশ্বাস করুন।
আমার মনে হয় ও ঠিকই বলছে, লোকটার সঙ্গে সুর মেলালাম।
ওর কথায় কান দিয়ো না, রবিন।
বাবার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। ভুল সাধারণত করে না বাবা। কিন্তু এবার নিশ্চয় করেছে। এই নিরীহ, অতি সাধারণ লোকটা মায়ানেকড়ে, রাতের বেলা রোমশ, বিশাল ভয়ঙ্কর প্রাণীতে পরিণত হয়, এ কথা কোনমতেই বিশ্বাস করতে পারলাম না।
বিকেলের রোদ গায়ে পড়েছে লোকটার। চকচকে টাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আমি মায়ানেকড়ে নই! আমার দিকে তাকিয়ে গুঙিয়ে উঠল লোকটা। বিশ্বাস করো। আমি মাছ-মাংসও খাই না, শুধু নিরামিষ।
যখন মানুষ থাকো তখন খাও না, কিন্তু মায়ানেকডে হয়ে গেলে কাঁচা মাংসই গপ গপ করে খাও! এখন চুপ থাকো! বেশি কথা বোলো না! হাত মুঠো করে বাতাসে নাচাল বাবা। আমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। আমিই প্রথম একটা জ্যান্ত মায়ানেকড়ে ধরেছি।
চোখ চকচক করছে বাবার। কখনও তাকে এত খুশি দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
ওকে আমরা বাড়ি নিয়ে যাব, বাবা বলল, টিভিতে হাজির করব। সারা দুনিয়াকে দেখাব। আমার কাঁধে হাত রাখল বাবা। আমরা অসাধ্য সাধন করেছি, রবিন। এখানকার কাজ শেষ। চলোএখন, যাই।
শিস দিতে দিতে মাটিতে নামিয়ে রাখা ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে কাঁধে ফেলল বাবা।
তুমি আগে আগে হাঁটো, বাবা বলল আমাকে। আমি পিছনে থাকব। আর এই জানোয়ারটা মাঝে হাঁটবে। পায়ে শিকল বাঁধা আছে। দৌড়ে পালাতে পারবে না। লোকটার পিঠে জোরে এক ধাক্কা দিয়ে বাবা বলল, হটো।
বাবার গায়ে যা জোর, এক হাতে উঁচু করে ঝোলাতে ঝোলাতে নিয়ে যেতে পারে লোকটাকে। প্রচণ্ড ধাক্কায় উপুড় হয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল লোকটা। পায়ে শিকল থাকায় ফুটখানেকের বেশি ফাঁক করতে পারছে না পা। চিৎকার করে বলল, আপনি ভুল করেছেন, মস্ত ভুল! আমি আপনাকে বলেছি, আমি মায়ানেকড়ে নই, আমি একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। আমার নাম হিউগ রেন। আমি ফার শিকারি। ফাঁদ পেতে জন্তু-জানোয়ার ধরি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, বটেই তো, ব্যঙ্গ করে বাবা বলল। তুমি ফার শিকারি হলে আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
আপনি আমার সঙ্গে এই ব্যবহার করতে পারেন না, তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল লোকটা। আমি পুলিশকে বললে আপনি ভীষণ বিপদে পড়বেন।
পুলিশকে জানালে আমি বিপদে পড়ব না, তুমি পড়বে।
কিন্তু আমার মনে হলো, ভুলটা বাবাই করছে। পুলিশকে জানালে বাবাই বিপদে পড়বে। নিরপরাধ একজন মানুষকে ধরে শিকল দিয়ে বাধার অপরাধে জেলেও যেতে হতে পারে তাকে।
তেরো
কয়েক দিন পর, জাহাজে করে বাড়ি ফিরে চললাম আমরা। জাহাজটা মালবাহী, কার্গো শিপ। যাত্রী বলতে আমি, বাবা, আর হিউগ রেন।
ব্র্যাটভিয়ার ভয়াল বন থেকে বেরিয়ে এসেছি। বাড়ি ফিরছি। আমার খুশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পারছি না। কেন, ঠিক বুঝলাম না।
হাতকড়া পরা রেনকে দেখে সন্দেহ দেখা দিল ক্যাপ্টেনের চোখে। খালাসিরা ভিড় করে এল।
বাবা ওদের বোঝাল, এই লোকটা ভয়ানক খুনী।
ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে পুলিশে দিচ্ছেন না কেন?
লোকটা মায়ানেকড়ে বললে, ভয়ে হয়তো ক্যাপ্টেন বাবাকে জাহাজেই উঠতে দেবেন না। পুলিশের কাছেই তো নিয়ে যাচ্ছি, বলে বাবা তার আইডেনটিটি কার্ড বের করে দেখাল। খবরের কাগজের লোক জেনে আর কিছু বললেন না ক্যাপ্টেন।
জাহাজের খোলে কার্গো হোল্ডে অন্যান্য মালপত্রের সঙ্গে রাখা হলো রেনকে।
বেচারা! অন্ধকার, ভাপসা গন্ধে ভরা কার্গো হোল্ডে থাকতে হবে ওকে পুরো সাতটা দিন আর রাত।
একটা কেবিন দেয়া হয়েছে আমাকে আর বাবাকে। নরম বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে রেনের কথা ভাবছি।
কার্গো হোল্ডে ওকে নামানোর সময় ওর আতঙ্কিত, জড়সড় হয়ে যাওয়া চেহারাটা চোখে ভাসছে।
সর্দি আরও বেড়েছে বেচারার। চোখ লাল। নাক দিয়ে অনবরত পানি গড়াচ্ছে। বড়ই করুণ দৃশ্য।
লোকটার জন্য মায়া হচ্ছে আমার।
বাবার দিকে তাকালাম। ডেস্কে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলছে। তার এক সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে। মায়ানেকড়েটাকে নিয়ে বড় বড় পরিকল্পনা করছে দুজনে।
খোলা সাগরে পড়তে প্রচণ্ড দুলতে লাগল জাহাজ। মাথা ঘুরছে আমার। সি-সিক হয়ে পড়ছি। গা গোলাচ্ছে।
লম্বা দম নিতে লাগলাম। ঢোক গিলোম। বমি ঠেকানোর চেষ্টা করলাম।
সাগর উত্তাল হয়ে উঠবে, বড় বড় ঢেউ হবে, সারাটা পথই এমন ৫ থাকবে, সাবধান করেছিলেন ক্যাপ্টেন। ঝড়ও আসতে পারে।
এখন যা অবস্থা, সারাপথ এমন হলে বেঁচে আর বাড়ি ফিরতে পারব বলে মনে হয় না!
খবরের কাগজকে তো অবশ্যই জানাতে হবে, তবে পরে, ফোনে বলছে বাবা। টিভিতে লাইভ শো? অস্থির ভঙ্গিতে চুলে আঙুল চালাল বাবা। তা তো হবেই। মায়ানেকড়েটা কীভাবে মানুষ থেকে মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হয়, দেখাব না? সেটাই তো আসল। তবে আগামী পূর্ণিমাটা যাক। আমরা আগে দেখি। দেখে শিওর হই। তারপর।