আমি জানি, উঠে বসতে গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে।
চাপা গরগর করে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছে ওগুলো। মায়ানেকড়ের দাঁতটার কথা মনে পড়ল আমার।
সাপুড়ে বুড়ো দাঁতটা দেখে ভয় পেয়েছিল। কুকুরগুলোও পেতে পারে।
আস্তে করে একটা হাত তুলে আনলাম গলার কাছে।
আরও কাছে এসেছে কুকুরগুলো। ওগুলোর দুর্গন্ধে ভরা গরম নিঃশ্বাস লাগছে আমার মুখে।
শার্টের ভিতরে হাত ঢোকালাম। কাঁপা হাতে গলায় পরা সুতোটা ধরলাম। আরও কাছে চলে এসেছে কুকুরগুলো। সুতোয় বাঁধা দাঁতটা খুঁজে বেড়াল আমার আঙুল। কোথায় ওটা? কোথায়? গরগরানি বেড়েছে কুকুরগুলোর। যে কোন মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মরিয়া হয়ে দাঁতটা খুঁজতে লাগলাম। সুতোটাকে টানছি। টানছি। কিন্তু দাঁতটা পেলাম না।
এগারো
মাথা উঁচু করলাম। জোরে এক টান দিলাম সুতো ধরে।
অবশেষে পেলাম ওটা। আমার গায়ের নীচে চাপা পড়ে ছিল। দুই আঙুলে টিপে ধরলাম। কুকুরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়তে এল। দাঁতটা উঁচু করে ধরলাম।
মাঝপথে যেন ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল কুকুরগুলো। পাথরের মূর্তির মত স্থির।
চিৎকার-চেঁচামেচি বন্ধ। নীরবে তাকিয়ে রয়েছে দাঁতটার দিকে।
তারপর, হঠাৎ নড়ে উঠল। ভয়ার্ত কুঁই কুঁই শব্দ করে লেজ গুটিয়ে পিছিয়ে গেল। সরে গেল আমার কাছ থেকে। দৌড়ে পালাল। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।
জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। বড় বাঁচা বেঁচেছি! সত্যি চলে গেছে কুকুরগুলো? সত্যি? বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার।
প্রচণ্ড ক্ষমতা এই দাঁতটার! হাতের তালুতে চেপে ধরলাম।
আমার জীবন বাঁচিয়েছে! এখন থেকে যত্ন করে রাখতে হবে এটাকে!
আবার শার্টের ভিতর ঢুকিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। খুলে যাওয়া জুতোটা তুলে নিয়ে পরলাম আবার। তারপর বাবাকে খুঁজতে চললাম।
বনের ভিতর ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একটা পায়েচলা পথের ওপর এসে পড়লাম।
বনটা এখন নীরব। কালো রঙের ওই পাখিগুলোকে আর দেখতে পাচ্ছি না। কট কট শব্দও নেই।
একটা কাঠবিড়ালী কিংবা খরগোশও চোখে পড়ছে না। কোনও প্রাণী দেখছি না। কোনও শব্দই নেই।
তবে এখন আর ভয় পাচ্ছি না আমি।
শার্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দাঁতটা ছুঁয়ে দেখলাম। অদ্ভুত এক নিরাপত্তাবোধ এনে দিয়েছে আমাকে ওটা।
কতক্ষণ হাঁটলাম বলতে পারব না।
বনের নতুন কোনও অংশে চলে এসেছি, না আগের বনটাতেই রয়েছি, বুঝতে পারলাম না।
বাবা! অ্যাই বাবা! গাছপালার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে চিৎকার করে ডাকলাম। আমার ডাক ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
কিন্তু বাবা জবাব দিল না।
অস্বস্তিতে ভুগছি। নাড়ির গতি বাড়ছে। আবার চিৎকার করে ডাকলাম, বাবা, শুনতে পাচ্ছ? জবাব নেই।
বাবা! কোথায় তুমি?
রবিন, তুমি কোথায়? জবাব এল এবার। কথাগুলো যেন শান্তির পরশ বোলাল আমার কানে।
বাবা! এই যে, এখানে! চেঁচিয়ে উঠলাম। তুমি কোথায়?
ওপরে তাকাও, রবিন। এখানকার সবচেয়ে উঁচু গাছটা খুঁজে বের করো।
ওপরে তাকিয়ে গাছের মাথা দেখলাম। করেছি, বাবা! আমি আসছি!
জলদি করো! বাবার কণ্ঠ উত্তেজনায় ভরা। আমি ওটাকে পেয়েছি, রবিন! মায়ানেকড়েটাকে ধরেছি!
দৌড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধে এগোচ্ছি। আসলে আমি পিছনে ফিরে পালাতে পারলে খুশি হতাম। মায়ানেকড়েটাকে আর দেখতে চাই না আমি। ইতিমধ্যেই দুবার দেখেছি। রাতের বেলা। গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে যখন আমার কাঁধ কামড়ে দিয়েছিল, তখন একবার, আর তাঁবুর ভিতরে খাটের পায়ের কাছে দ্বিতীয়বার, যখন আমাকে দাঁতটা ছুঁড়ে দিয়েছিল। তৃতীবার আর ওটার দিকে তাকাতে চাই না।
উঁচু একটা গাছের ফাঁকে বাবার লাল শার্ট দেখতে পেলাম। আমার কপাল থেকে ঘাম বেয়ে মুখে পড়ছে। ছুটে বেরোলাম একটা খোলা জায়গায়। বিস্ময়ে চমকে উঠলাম। বাবার মায়ানেকড়ে দেখে চেঁচিয়ে বললাম, বাবা, তোমার কী মাথা খারাপ হলো?
বারো
বাবা, তুমি আমার সঙ্গে মজা করছ, তাই না? আবার বললাম।
গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। গর্বিত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে তার শিকারের দিকে। অতি সাধারণ চেহারার, বিষণ্ণ, টাকমাথা এক মধ্যবয়েসী মানুষকে শিকল দিয়ে বেঁধেছে। হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। পায়ে কড়া লাগানো। তাতেও মোটা শিকল।
সামান্য কুঁজো হয়ে আছে মানুষটা। পরনে সাদামাঠা প্যান্ট ও শার্ট। চোখে চশমা।
মায়ানেকড়ে কোথায়, বাবা? জিজ্ঞেস করলাম। হাসিমুখে হাত তুলে মানুষটাকে দেখাল বাবা।
মাথা নাড়লাম। একে তুমি মায়ানেকড়ে বলছ? এ তো একটা মাছি মারতে পারবে না।
আমার কথায় সাহস পেয়ে যেন বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল লোকটা। হাঁচি দিল।
সর্দি লেগেছে, দেখো! বাবাকে বললাম। মনে হচ্ছে লোকটা অসুস্থ। অকারণে বেঁধেছ ওকে। খুলে দাও, বাবা।
রুমাল আছে? নাক টানতে টানতে জিজ্ঞেস করল লোকটা।
এই যে! পকেট থেকে রুমাল বের করে দিলাম।
রবিন, দিয়ো না! চেঁচিয়ে উঠল বাবা। থাবা দিয়ে আমার হাত সরিয়ে দিল। ও চালাকি করছে!
বনে এসে মায়ানেকড়ের খোঁজ করতে করতে বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ভাবলাম।
আবার হাঁচি দিল লোকটা।
বাবা, ও মায়ানেকড়ে, শিওর হলে কী করে? ছোটখাট মানুষটার অসহায়ত্ব দেখে মায়াই লাগছে আমার।
মায়ানেকড়ের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়েছি। ওর ঘরের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে ছাপ। তারপর আর কোন চিহ্ন নেই। হঠাৎ করেই পায়ের ছাপ উধাও। ভুরু নাচাল বাবা। ও মায়ানেকড়ে নয় তো কী?