লোকটা যেদিন বনে ঢুকল, তার দুদিন পর ছিল পূর্ণিমা। গোল হয়ে এসেছিল চাঁদ। সারারাত নেকড়ের অস্থির ভয়ঙ্কর ডাক শোনা গেল বনের মধ্যে। বনের বাইরে গ্রাম থেকে অনেকেই শুনেছে সেই ডাক।
পরদিন সূর্য ওঠার পর থেমে গেল ডাকাডাকি। গ্রামের কয়েকজন দুঃসাহসী, লোক বনে ঢুকল, রাতে কী ঘটেছিল জানার জন্যে। বনের মধ্যে অনেক প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখল ওরা। ভয়ঙ্কর আক্রোশে যেন ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়েছে দেহগুলো। কোনটা খাওয়া, কোনটা আধখাওয়া।
আরও একটা জিনিস চোখে পড়ল ওদের, নেকড়ের পায়ের ছাপ। ব্যাপারটা খুব রহস্যময় লাগল ওদের কাছে।
পরের রাতেও শোনা গেল নেকড়ের ডাক। তারপর দিন বনে ঢুকে সেই একই রকম বীভৎস দৃশ্য দেখল ওরা। ঠিক করল, রাতে বনের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দেখবে, এ-সব কার কাজ।
তৃতীয় পূর্ণিমা। সন্ধ্যাবেলায়ই গাছে উঠে লুকিয়ে রইল ওরা। রাত বাড়ল। চাঁদের আলো উজ্জ্বল হলে ওরা দেখল, একটা বড় গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে নামল একজন মানুষ। ওকে চিনতে পারল ওরা। সেই অহঙ্কারী লোকটা। সন্ন্যাসীর কেবিনে ঢোকার আগে ওদের গ্রাম হয়েই এসেছিল। যাই হোক, ওদের চোখের সামনে নেকড়ে হয়ে লোকটা। চাঁদের দিকে মুখ তুলে হাঁক ছাড়ল।
একটা খরগোশ পালাচ্ছিল সামনে দিয়ে। চোখের পলকে ওটাকে ধরে আস্তই চিবিয়ে খেয়ে ফেলল।
আর বনে থাকতে সাহস হলো না গ্রামবাসীদের। টপাটপ গাছ থেকে নেমে দৌড়ে পালাল। গাঁয়ে ঢোকার আগে আর থামল না কেউ।
ওদের ভাগ্য ভাল ছিল, তাই পালাতে পেরেছিল।
তারপর, আরও কিছু লোক ওই আজব প্রাণীটাকে ধরতে বনে গিয়েছিল। কিন্তু ওরা আর ফেরেনি। জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল বুড়ো।
তারপর থেকে রাতের বেলা এই বনে কেউ ঢোকে না।
বাবাকে কিছু করবে না তো? শঙ্কিতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রবিন।
না মনে হয়। এখন তো দিন। রোদ ওঠার পর আর কোন ক্ষতি করে না মায়ানেকড়েরা! দিনে কোন ক্ষমতা থাকে না। টেবিলের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার একটা হাত ধরল বুড়ো। হেসে জিজ্ঞেস করল, তোমার হাত দেখে ভাগ্য বলে দেব?
জবাব না দিয়ে হাতের তালু মেলে দিলাম।
এই যে তোমার ভাগ্যরেখা। লম্বা একটা হাড়সর্বস্ব আঙুলের ডগা আলতো করে ঠেলে দিল বুড়ো আমার হাতের তালুতে
ভাল করে দেখার জন্য সামনে ঝুঁকলাম। শার্টের ভিতর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ঝুলতে লাগল আমার গলায় পরা দাঁতটা।
দেখে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল বুড়ো। মায়ানেকড়ের চিহ্ন! কোথায়। পেলে? কোথায় পেলে ওটা? বেরোও! বেরোও আমার ঘর থেকে!
নয়
চিৎকার করতে করতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল বুড়ো।
ফায়ারপ্লেসের পাশ থেকে একটা কয়লা খোঁচানোর সিক তুলে নিল।
চারপায়া থেকে লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে ছুটলাম।
ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গাটা ধরে দৌড় দিলাম। একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে ধুড়স করে পড়ে গেলাম।
পিছনে আসছে বুড়ো। হাতে সিক। মায়ানেকড়ের চিহ্ন! ভাগো! ভাগো এখান থেকে! একনাগাড়ে চেঁচিয়ে চলেছে ও।
হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে লেংচাতে লেংচাতে একদৌড়ে বনে ঢুকে পড়লাম। রাস্তাটা কোনদিকে আছে জানি না। দেখার সময়ও নেই।
গাছপালার ভিতর দিয়ে অন্ধের মত ছুটলাম। গাছের শিকড়ে পা বেধে যাচ্ছে। হাতে-মুখে লাগছে গাছের ডাল। সড়াৎ সড়াৎ বাড়ি খাচ্ছি। কিন্তু কোন কিছুর পরোয়া করলাম না।
ছুটতেই থাকলাম যতক্ষণ না বুড়োর চিৎকার ক্ষীণ হয়ে এল।
দৌড়াতে দৌড়াতে পা ব্যথা করছে, তবু থামলাম না। আরও কিছুদূর এগিয়ে তারপর থামলাম।
এতক্ষণে চিন্তা করার সুযোগ পেলাম। বুঝলাম না, দাঁতটাকে এত ভয় পেল কেন বুড়ো।
পিছনে কুকুরের ডাক শোনা গেল। উত্তেজিতস্বরে ডাকছে কুকুরগুলো।
মায়ানেকড়ে দেখল! চমকে গেলাম।
পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম।
না, মায়ানেকড়ে দেখেনি। তবে তাতে আমার উৎসাহিত হবার কিছু নেই। ভয়ঙ্কর বুনো কুকুর ওগুলো। দশ-বারোটা হবে। কুৎসিত চেহারা। কাদামটি লেগে থাকা নোংরা লোম। হলদে চোখের দৃষ্টি দেখলে অতিবড় দুঃসাহসীরও প্রাণ কেঁপে যাবে। ঝুলে পড়া নীচের চোয়াল থেকে লালা গড়াচ্ছে।
চাপা গরগর করে হাড্ডিসার মাথাগুলো নামাল ওরা। আমাকে ঘিরে ঘুরতে শুরু করল। কট কটু করে যেন বাতাসে কামড় দিচ্ছে।
যে-কোন মুহূর্তে এই কামড়টা আমার পায়ে পড়বে।
একটা গাছের দিকে দৌড় দিলাম। পাগলের মত গাছটাকে জড়িয়ে ধরে বেয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম।
প্রচণ্ড জোরে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল কুকুরগুলো। লাফিয়ে উঠল। থাবা মারতে লাগল গাছের গায়ে।
একটা কুকুর লাফিয়ে উঠে আমার জুতো কামড়ে ধরল। মাথা ঝাঁকি দিয়ে আমাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করল।
চেঁচিয়ে উঠে হ্যাঁচকা টান মারলাম। পা থেকে জুতো খুলে গেল। জুতোটা মুখে নিয়ে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল কুকুরটা।
আরেকটা কুকুর আমার মোজা কামড়ে ধরল।
লাথি মেরে ফেলে দিলাম ওটাকে। হাতে ভর দিয়ে নিজেকে টেনে, তোলার চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ পিছলে গেল হাত। চেঁচিয়ে উঠলাম। চিত হয়ে পড়লাম। মাটিতে। একেবারে ক্ষুধার্ত কুকুরগুলোর মাঝখানে।
দশ
আমাকে ওভাবে পড়তে দেখে থমকে গেল কুকুরগুলো।
জিভ বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে দেখছে আমাকে। যেন আমার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছে।
যখন বুঝল, কিছু করার সাধ্য নেই আমার, ধীরে ধীরে সামনে এগোতে শুরু করল আবার।