ধীরে হাঁটছি এখন। নীরবে এগিয়ে চললাম বনের ভিতর দিয়ে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে চলেছি, গাছপালার মধ্যে বাবাকে খুঁজছে আমার চোখ। তার লাল শার্ট, সবুজ ব্যাকপ্যাক দেখতে চাইছে।
নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রতিটি শব্দ–সেটা যত সামান্যই হোক–তার সরসরানি, মটু করে শুকনো কুটো ভাঙা, বুনো প্রাণী কিংবা পাখির ডাক চমকে দিচ্ছে আমাকে, লাফিয়ে উঠছে হৃৎপিণ্ড, ভয়ে।
সামনে ধীরে ধীরে চওড়া হচ্ছে রাস্তাটা। দুপাশে গাছপালা কমে আসছে। রোদের আলো বাড়ছে।
তারপর, হঠাৎ করেই বেরিয়ে এলাম একটা খোলা জায়গায়।
রোদ ঝলমল করছে গোলাকার জায়গাটুকুতে। আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও সামলে নিলাম।
খোলা জায়গার একপ্রান্তে একটা ছোট কাঠের তৈরি কেবিন। চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে।
পা টিপে টিপে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। ঠেলা দিতেই ফাঁক হয়ে গেল পাল্লাটা। ভিতরে উঁকি দিলাম। ঘরে একটা চারপায়া, পুরানো একটা টেবিল, আর নড়বড়ে দুটো চেয়ার। একপাশে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। একধারে বেড়া ঘেষে রাখা কতগুলো কাঠের বাক্স।
ঘরে আর কী কী আছে গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ বাজখাই কণ্ঠে পিছন থেকে হাক শোনা গেল, কী চাই?
এমন এক লাফ মারল কলজেটা, মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাব।
ফিরে তাকিয়ে দেখি, একজন বুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে। চুলে কতকাল যে তেল-সাবান আর চিরুনি পড়েনি কে জানে। মস্ত গোঁফ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাংসহীন তোবড়ানো চোয়ালের ফাঁকে বসে গেছে গালের কুঁচকানো চামড়া। লম্বা নাকটা ঈগলের ঠোঁটের মত বাঁকা হয়ে নেমে এসেছে মস্ত গোঁফের ওপর। চোখের মণি দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল আর চকচকে। কাঁধে ঝুলছে একটা লম্বা মোটা কাপড়ের ঝোলা। নীচের দিকটা ঝুলে রয়েছে। কিছু আছে ভিতরে।
কী চাও, খোকা? আবার জিজ্ঞেস করল বুড়ো।
আমি…আমি পথ হারিয়েছি, কোনমতে বললাম।
এসো, ভিতরে এসো। ধাক্কা দিয়ে দরজাটা পুরো খুলে ঘরে ঢুকে গেল বুড়ো।
আমিও ঢুকলাম। দরজার খিল লাগিয়ে দিল বুড়ো। এ-সব জায়গায় দরজা খোলা রাখা ঠিক না। কখন আবার কী এসে হাজির হবে, কে জানে!
এসো। বসো। হাড়সর্বস্ব আঙুল দিয়ে আমার কাঁধ চেপে ধরে চেয়ারের কাছে ঠেলে নিয়ে এল লোকটা। চাপ দিয়ে বসিয়ে দিল। তার মত একজন বুড়ো মানুষের গায়ের জোর অবাক করল আমাকে।
এ রকম ভয়ানক জায়গায় এলে কেন? বুড়োর বরফশীতল চাহনি। দেখে ঠাণ্ডা শিহরণ নেমে গেল আমার মেরুদণ্ড বেয়ে।
আমি যাই! উঠে দাঁড়াতে গেলাম।
বসো! কড়া আদেশ যেন শপাং করে উঠল চাবুকের মত। এই বন বড় ভয়ানক জায়গা। বুঝতে পারছি তুমি শহুরে ছেলে। এখনও যে ভালুকের পেটে যাওনি সেটাই আশ্চর্য! খানিকটা নরম হলো বুড়োর স্বর। বনের ভিতর একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলে কেন?
একা ছিলাম না, বাবার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম, জবাব দিলাম। পিছনে চলতে চলতে হঠাৎ মুখ তুলে দেখি বাবা নেই।
চিন্তার কথা! গম্ভীর হয়ে গেল লোকটা।
ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আপনি বলতে চান, আমার বাবাকে মায়ানেকড়েতে ধরে নিয়ে গেছে?
যতদূর জানি, দিনের বেলা মায়ানেকড়েরা বেরোয় না। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে লোকটা বলল, কী হয়েছিল, সব খুলে বলো তো আমাকে।
কেন আমরা ব্র্যাটভিয়ায় এসেছি, বললাম তাকে। শুনে আরও গম্ভীর হয়ে গেল বুড়ো। বলল, মায়ানেকড়ে কিন্তু এখানে সত্যিই আছে।
আছে?
আছে। লোকের কথা তো আর মিথ্যে না। তুমি বসো। চা খাও। ততক্ষণে যদি তোমার বাবা তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে না আসেন, আমি তোমার সঙ্গে তাকে খুঁজতে বেরোব।
প্রথমে ঝোলা থেকে একটা বড় সাপ বের করে দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা বাক্সে ঢোকাল বুড়ো। তারপর স্টোভ জ্বেলে একটা পুরানো কেটলিতে চায়ের পানি চাপাল। ফিরে এসে আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসল।
আপনি নিশ্চয় সাপ ধরেন?
কী করে বুঝলে?
এই যে, ঝোলা থেকে সাপ বের করে রাখলেন, দেখলাম তো। সবগুলো বাক্সেই কি সাপ আছে?
না। বাক্সগুলো সব ভরে গেলে প্রথমে সাপের বিষ বের করে নেব। তারপর বিষসহ সে-সব সাপ শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিয়ে আসব। এটাই আমার পেশা।
পানি গরম হলে দুটো তোবড়ানো টিনের কাপে চা বানিয়ে এনে একটা আমাকে দিল বুড়ো, আরেকটা নিজে নিল। কাপে চুমুক দিয়ে বলল, কয়েক বছর আগের কথা। আমি আসার আগে এই কেবিনে একজন সন্ন্যাসী থাকতেন। একদিন শহর থেকে এল সেই অহঙ্কারী লোকটা। সব ছারখার করে দিল।
অহঙ্কারী লোক?
হ্যাঁ, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল বুড়ো। বনে শিকার করতে এসে সন্ন্যাসীর কেবিনে ঢুকেছিল। তাঁর সঙ্গে বেয়াদবি করেছিল। সন্ন্যাসী ওকে কি করেছিলেন, কেউ জানে না। তবে কেবিন থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে গভীর বনের দিকে চলে যায় লোকটা।
সন্ন্যাসী?
হ্যাঁ, সন্ন্যাসী। কেন?
না, এমনি। তাঁবুতে ঢুকে যে লোকটা ওকে মায়ানেকড়ের দাঁতটা দিয়েছেন, তিনিই সেই সন্ন্যাসী কি না ভাবছে রবিন। জিজ্ঞেস করল, সন্ন্যাসী এখন কোথায়?
তা তো বলতে পারব না। অহঙ্কারী লোকটা মায়ানেকড়ে হয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পর এই কেবিন ছেড়ে চলে গেছেন। তবে গাঁয়ের লোকে মাঝে মাঝে দেখে ওঁকে। বনে ঢোকেন। কোথা থেকে আসেন, কোথায় যান, কেউ জানে না।
হুঁ! চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল রবিন। তারপর বলল, হ্যাঁ, বলুন, অহঙ্কারী লোকটার কী হলো?