বাবা কড়াইয়ের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। নীল জিনসের প্যান্ট আর লাল রঙের শার্ট পরেছে। মাথায় দিয়েছে একটা নীল রঙের ক্যাপ।
কী হয়েছে, বাবা? জিজ্ঞেস করলাম। চেঁচাচ্ছ কেন?
ডিম ঠাণ্ডা হয়ে গেল, হেসে জবাব দিল বাবা।
ধুর, হেসো না তো, হতাশ হয়ে বললাম।
তুমি কী ভেবেছিলে মায়ানেকড়ে দেখে ডেকেছি? কড়াই থেকে হাতা দিয়ে দুটো প্লেটে ডিম তুলল বাবা। একটা আমাকে দিল। চিন্তা নেই, আজ একটাকে ধরবই আমি।
চামচে করে খানিকটা ডিম তুলে মুখে পুরলাম। কিন্তু গিলতে পারলাম না। বিস্বাদ লাগছে। কারণটা বুঝলাম না।
বাবা কাপে কফি ঢালছে।
তার অলক্ষে মুখের ডিমটা ফেলে দিলাম। সত্যিই কোন বিপদ হবে না তো?
তা তো হতেই পারে, বাবা জবাব দিল। তাই বলে কী পিছিয়ে থাকব? তবে ভয় নেই, আগেই বলেছি, দিনের বেলা মায়ানেকড়ের কোন ক্ষমতা থাকে না।
হয়তো থাকে, তুমি জানো না।
উঁহু, থাকে না।
এত শিওর হচ্ছ কী করে?
তোমার কী ধারণা, ভালমত খোঁজ-খবর না নিয়েই আমি এসেছি?
বাবার কথায় শঙ্কামুক্ত না হলেও আর কিছু বললাম না।
নাস্তা শেষ করে বাবা বলল, তাঁবু গোটাও।
আমার তাঁবুটা গোটালাম। বাবার তাঁবুটা বাবা গোটাল। বড় বড় দুটো সবুজ ব্যাকপ্যাকে সমস্ত জিনিসপত্র ভরলাম। তারপর পিঠে বেঁধে রওনা হলাম গভীর বনের দিকে।
কোনদিকে যেতে হবে কী করে বুঝছ? বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।
এই যে, ছাপ অনুসরণ করে। নরম কাদামাটিতে গভীরভাবে বসা মায়ানেকড়ের পায়ের ছাপ দেখাল বাবা।
দেখে কেঁপে উঠলাম।
ঘন বনের ভিতর দিয়ে চলেছি। গাছপালা সূর্য ঢেকে দিয়েছে। কাঁধের ব্যাকপ্যাক অন্য কাঁধে সরানোর জন্য থামলাম। চারপাশে তাকিয়ে ভাবলাম, এত অন্ধকার কেন বনটা? এত বিষণ্ণ!
বাবা! দাঁড়াও! ব্যাকপ্যাকটা কাঁধ বদল করলাম।
কিন্তু বাবা থামল না। জোর কদমে এগিয়ে চলেছে। লাফাতে লাফাতে
পায়ে যেন স্প্রিং লাগানো। মায়ানেকড়ে ধরার জন্য অস্থির। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
দৌড়ে এলাম বাবার কাছে।
ওই যে! ফিসফিস করে বাবা বলল। আমি ওটাকে দেখতে পাচ্ছি! উত্তেজনায় গলা কাঁপছে তার।
আঁকাবাঁকা, মোচড় খাওয়া পথটা ধরে দৌড়াতে শুরু করল বাবা।
আমিও ছুটতে লাগলাম তার পিছন পিছন। বুকের ভিতর ধড়াস। ধড়াস বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ডটা।
আরও জোরে দৌড়াতে লাগল বাবা। রাস্তা থেকে নেমে গাছপালার ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটল।
সামনে একঝলক বাদামী রঙ দেখলাম। আবার দাঁড়িয়ে গেলাম।
ওই যে! ধূর! আমি ভেবেছিলাম মায়ানেকড়ে! প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে বাবা।
আমিও দেখেছি।
ভীত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ছোট একটা বাদামী রঙের শিয়াল।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল বাবা। নাহ্, এখন যে সকাল, দিন, মায়ানেকড়েরা মানুষের রূপ নিয়ে আছে, ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি আমার। যাক, একবার করেছি, আর ভুল করব না।
ফিরে এসে আবার রাস্তায় উঠল বাবা। আবার এগিয়ে চলার পালা।
বনের ভিতরে পাখির কোলাহল। এত পাখি, আর এভাবে কখনও ডাকতে শুনিনি। বিচিত্র চিৎকারে কান ঝালাপালা করছে।
আরেকটু এগিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে চমকে গেলাম। কালো রঙের পাখিতে বোঝাই গাছের ডালগুলো। শত শত। পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসেছে। পাখিগুলোর চোখ টকটকে লাল। লম্বা, চোখা ঠোঁট খুলছে আর বন্ধ করছে কট কট শব্দে।
এই পাখি আর আগে কখনও দেখিনি।
পাখিগুলোর ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে হাজার হাজার লাল ভূতুড়ে চোখ যেন কুটিল দৃষ্টিতে আমাদের দেখছে। বার বার ঠোঁট খুলে, বন্ধ করে আমাদেরকে যেন কোনও ভয়ঙ্করের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ওরা কী রেগে গেছে? পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।
না, ওগুলোর খিদে পেয়েছে।
তাকিয়ে আছি পাখিগুলোর দিকে। মানুষখেকো?
বাবা জবাব দিল না।
ওগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হতে থাকল, যে-কোন মুহূর্তে ঝাক বেঁধে আমাদের ঠোকরাতে আসবে। এত পাখি একসঙ্গে হামলা চালালে কিছুই করতে পারব না। এ ভয় পেলেও পাখিগুলোর ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। যেন আঠা দিয়ে ওগুলোর গায়ে আমার দৃষ্টিটা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাবা, বলো না, ওরা মানুষখেকো নাকি? জবাব না পেয়ে জোর করে চোখ সরালাম পাখিগুলোর দিক থেকে।
রাস্তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।
শূন্য রাস্তা। বাবাকে দেখা যাচ্ছে না।
বাবা, কোথায় তুমি? চিৎকার করে ডাকলাম।
জবাব নেই। আবার চিৎকার করলাম। সাড়া এল না।
গাছপালার ভিতর দিয়ে ছুটতে শুরু করলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে। কিন্তু কোথাও দেখলাম না তাকে।
ইস, কেন যে পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম? গুঙিয়ে উঠলাম।
বনের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার মরিয়া দৃষ্টি।
আমি এখন কোথায়? নিজেকে প্রশ্ন করতে গিয়ে প্রায় কেঁদে ফেললাম। গাছগুলো তো সব প্রায় একই রকম লাগছে! এই বন থেকে আমি আর কোনদিন বেরোতে পারব না! আমাকেও কেউ খুঁজে পাবে না এখানে! বাবা! বাবা! কোথায় তুমি?
আট
চিৎকার করে বাবাকে ডাকতে ডাকতে বুনোপথ দিয়ে ছুটলাম।
আমার তীক্ষ্ণ ডাক প্রতিধ্বনি তুলল বনের গাছে গাছে। কিন্তু কোন জবাব পেলাম না। বাবার কোন চিহ্নই দেখলাম না।
জোরে জোরে হাঁপাচ্ছি। ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমার গলা শুকিয়ে। কাঠ। চিৎকার করে করে কণ্ঠনালী খসখসে হয়ে গেছে।