মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতায় পা পড়ে মর্মর ধ্বনি উঠছে। ভেজা মাটির গন্ধ লাগছে নাকে। একটানা দৌড়ে চলেছি আমি। কুকুরের মত জিভ বের করে হাঁপাচ্ছি।
নাহ্! এই দুঃস্বপ্ন দেখাটা বন্ধ করতে হবে স্বপ্নের মধ্যেই বললাম।
জোর করে জেগে উঠলাম। চোখ মেলোম। বাতাসের জন্য হাঁসফাস করছি। বিড়বিড় করলাম, এটা দুঃস্বপ্নই ছিল। ভয়ঙ্কর আরেকটা দুঃস্বপ্ন।
তাঁবুর ভিতর অন্ধকার। এখনও রাত, বুঝতে অসুবিধে হলো না। বিছানায় উঠে বসলাম। হাঁপাচ্ছি। এই সময় চোখ পড়ল পায়ের দিকে। চমকে উঠলাম।
বিছানার পায়ের কাছে দুটো কালো চোখ অন্ধকারেও চকচক করছে।
নিশ্চয় মায়ানেকড়ে!
ছয়
আমাকে মেরো না, প্লিজ! ফিসফিস করে বললাম। জোরে বলার সাহস পাচ্ছি না।
মায়ানেকড়েটা নড়ল না।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। চকচকে চোখজোড়া দিয়ে যেন সম্মোহিত করার চেষ্টা করছে আমাকে।
ধড়াস ধড়াস করছে আমার বুক। চোখ সরাতে পারছি না। যেন আঠা দিয়ে ওই দুটো চোখের সঙ্গে আমার চোখ সেঁটে দেয়া হয়েছে।
চেঁচাও, রবিন, চেঁচাও! চেঁচাও! বাবাকে ডাকো! নিজেকে বলতে লাগলাম।
বাবা! আচমকা চিৎকারটা যেন বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে গেল আমার মুখ থেকে। বাবা!
ঝটকা দিয়ে চোখ দুটো অন্যদিকে ঘুরে গেল। তাঁবুর পর্দাটা দেখল। একটা থাবা উঁচু করল। আমার ক্যাম্প খাটে কিছু একটা ছুঁড়ে দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
আশ্চর্য! মানুষের মত দুই পায়ে ছুটে পালিয়েছে, ছায়ামূর্তিটা। পলকের জন্য গায়ের ঢোলা আলখেল্লাও দেখেছি। নেকড়ে নয়, মানুষ! কে লোকটা?
বাবা!
কী হয়েছে, রবিন? বাবার তাঁবু থেকে জবাব শোনা গেল। আমি তাঁবুতেই আছি, তোমার কাছাকাছি। ভয় নেই।
লাফ দিয়ে নামার সময় এত তাড়াহুড়ো করলাম, টান লেগে কাত হয়ে গেল ক্যাম্প খাটটা। তাঁবুর দেয়ালে আছড়ে পড়ে আরেকটু হলেই ভাবুটা ধসিয়ে দিয়েছিল।
কী? তাঁবুতে ঢুকল বাবা। রবিন, কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?
বাবা, একজন লোক এসেছিল! গলা কাঁপছে আমার। হাত তুলে দেখালাম লোকটা কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল।
তোমাকে কিছু করেনি তো?
না, কিছু করেনি।
কিন্তু এতরাতে কে? বিড়বিড় করল বাবা। নিশ্চয় মায়ানেকড়েটাই মানুষের রূপ ধরে তোমার কাছে এসেছিল। ঘুরে দাঁড়াল বাবা। দেখি তো, কোথায় গেল!
কিন্তু… আমি কথা শেষ করার আগেই বেরিয়ে গেল বাবা।
খাটটা তুলে সোজা করলাম। গায়ের কাঁপুনি এখনও থামেনি আমার। খাটে বসলাম। বিড়বিড় করে নিজেকে প্রশ্ন করলাম: মায়ানেকড়েই যদি হয়ে থাকে, তাঁবুতে ঢুকল কেন ওটা?
জবাব পেলাম না। বসে আছি তো আছিই। বাবা আর আসে না। উদ্বেগ বাড়ছে আমার। মনে এলোমেলো ভাবনা। শেষে ডাক দিলাম, বাবা? জবাব এল না। বাবা, তুমি কোথায়?
এবারও জবাব নেই। ভয়টা বাড়ল আমার। বাবার কিছু ঘটেনি তো? সাংঘাতিক কিছু?
মায়ানেকড়েটা তাকে ধরার জন্য ঘাপটি মেরে ছিল না তো? যেই বাগে পেয়েছে, অমনি খপ করে ধরেছে!
গেলে ভাল করতাম! ভেবে খাট থেকে উঠে দাঁড়ালাম। একজনের জায়গায় দুজন থাকলে সুবিধে।
বাইরে বেরোতে গিয়ে মেঝেতে চোখ পড়ল। থমকে দাঁড়ালাম। সাদা চকচকে কী একটা যেন পড়ে রয়েছে তাঁবুর কোণে।
কি ওটা? এগিয়ে গিয়ে তুলে নিলাম।
একটা দাঁত। বেশ বড়। নিশ্চয় হিংস্র কোন মাংসাশী জানোয়ারের। মোটা, শক্ত সুতোয় দাঁতটা হারের লকেটের মত করে বাঁধা।
বিচিত্র জিনিসটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম।
এল কোথা থেকে এটা?
মায়ানেকড়ে! হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে। আমার খাটে ছুঁড়ে দিয়েছিল। খাটটা উল্টে গিয়েছিল। তখন এটা মাটিতে পড়ে গেছে।
হারের সুতো ধরে উঁচু করলাম। মনে হলো, মায়ানেকড়ের দাঁত নইলে এতবড় দাঁত আর কোন প্রাণীর হবে?
বাবাকে খুঁজে বের করা দরকার। মায়ানেকড়েতে যেহেতু ছুঁড়ে দিয়ে গেছে, নিশ্চয় এটার কোন ক্ষমতা আছে। কী ক্ষমতা, বাবা দেখলে বলতে পারবে।
ছুটে বাইরে বেরোলাম। পড়লাম একেবারে বাবার সামনে। দরজার ঠিক বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।
তোমাকে না দেখে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল বাবা, তাই দেখতে যাচ্ছিলাম।
ওটাকে পেলাম না, রবিন। কুটি করল বাবা। রাতে ওদের নাগাল পাওয়া খুবই কঠিন। কাল দিনের বেলা চেষ্টা করতে হবে।
দেখো, বাবা। দাঁতটা উঁচু করে দেখালাম। তাঁবুতে ঢুকে এটা আমার বিছানায় ছুঁড়ে দিয়েছিল মায়ানেকড়েটা। মায়ানেকড়ের দাঁত না তো?
হাতে নিল বাবা। দেখতে দেখতে বলল, আশ্চর্য! মায়ানেকড়ে এটা তোমাকে দিল কেন?
এটার কোন ক্ষমতা আছে?
মাথা নাড়ল বাবা। জানি না। তবে দিয়ে গেছে যখন, নিশ্চয় কোনও রহস্যময় কারণে বিপদ-আপদ থেকে তোমাকে মুক্ত রাখতে চায় ॥ হারটা আবার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, নাও, গলায় পরে ফেলো।
মাথা গলিয়ে হারটা গলায় নামিয়ে আনলাম। আমার বুকের কাছে চামড়ায় অদ্ভুত দাঁতটার স্পর্শ লাগতে গায়ে কাঁটা দিল। শিউরে উঠলাম। বোধহয়, ঠাণ্ডায়।
তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম তাঁবুতে। খাটে শুয়ে কম্বল টেনে দিলাম মাথার ওপর।
সাত
রবিন! রবিন! জলদি এসো! পরদিন বাবার চিৎকারে ঘুম ভাঙল আমার।
তাড়াতাড়ি খাট থেকে নামলাম।
জলদি এসো তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকল আবার বাবা। নিশ্চয় মায়ানেকড়ে দেখেছে। দৌড়ে বেরোলাম তাঁবু থেকে।
পাগলের মত চারপাশে তাকালাম। মায়ানেকড়ে দেখলাম না।