আরেকটা ডাল ভাঙার শব্দ হলো। আমার মাথার ওপর। বরফের মত জমে গেলাম। মৃদু গর্জন কানে এল। তারপর আবার আরেকটা ডাল ভাঙার শব্দ।
ওপর দিকে তাকালাম। একজোড়া জ্বলন্ত চোখের দিকে চোখ। পড়ল আমার।
কি ওটা? জানোয়ার?
না অন্য কিছু? ভালমত দেখার সময় পেলাম না। গাছ থেকে লাফিয়ে নামল ওটা। সরে দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠলাম। চিৎকার করতে মুখ খুললাম। স্বর বেরোল না।
অর্ধেক মায়ানেকড়ে, অর্ধেক মানুষ
একটা জন্তু চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গা-ভর্তি লোমগুলো চাঁদের আলোয় চকচক করছে।
আমার দিকে তাকিয়ে চাপা গরগর করতে লাগল। মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে।
আতঙ্কে নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল আমার। এক পা পিছিয়ে গেলাম।
প্রাণীটার মুখ মায়ানেকড়ের মত। দেহটা মানুষের। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বড় বড় দাঁত।
আতঙ্কিত হয়ে ঘুরে দৌড় দিতে যাব, ভয়ঙ্কর এক গর্জন করে আমার ওপর লাফিয়ে পড়ল ওটা।
কাঁধে তীক্ষ্ণ ব্যথা লাগতে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। আমার কাঁধে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে ওটা। মাথা চক্কর দিচ্ছে আমার।
কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চোখের সামনে আঁধার হয়ে আসছে। সবকিছু।
মনে হলো, অন্ধকারে নীচে পড়ে যাচ্ছি। পড়ছি…পড়ছি…
পাঁচ
গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ে লাগতে ভূতুড়ে প্রাণীটা ফিরে এসেছে ভেবে চেঁচিয়ে। উঠলাম, অ্যাই, যা! ভাগ! ভাগ! বাবা, বাঁচাও!
আমার কাঁধে একটা হাত পড়ল। না না, হাত না, থাবা! নিশ্চয় মায়ানেকড়ের থাবা!
বাঁচাও, বাঁচাও! বলে চেঁচিয়ে উঠলাম আবার।
রবিন, কী হয়েছে? স্বপ্ন দেখছিলে? ওঠো, ওঠো।
খুলে গেল আমার চোখের পাতা। আমার ক্যাম্প খাটের কিনারে বসে আছে বাবা। আমার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। একটা হাত আমার কাঁধে।
রবিন, কী হয়েছে তোমার? বাবার চোখ উদ্বেগে ভরা।
উঠে বসলাম। ক্যাম্প খাটে শুয়ে আছি! আশ্চর্য!
তাঁবুতে এলাম কীভাবে? কিছুই মনে করতে পারলাম না। তবে কী বেরোইনি? কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, আঁচড়ের শব্দ পেয়ে আমি তাঁবু থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
পায়ের শব্দ শুনে বনের ভিতর দিয়ে গেছি। মায়ানেকড়ে দেখেছি। আমার কাঁধে কামড়ে দিয়েছে।
ঘটনাটা যে বাস্তব ছিল, কাঁধের দপদপে ব্যথাই সেটা বুঝিয়ে দিল। না। ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল না। সত্যি সত্যি মায়ানেকড়ের খপ্পরেই পড়েছিলাম।
তাঁবুতে ফিরলাম কী করে? বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।
আমি তুলে এনেছি, বাবা বলল। জানোয়ারটাকে তোমার গায়ের ওপর চেপে থাকতে দেখলাম। তাড়িয়ে দিয়েছি। বাবার মুখ উত্তেজনায় লাল।
সত্যিই চলে গেছে? তুমি শিওর? জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বালিশে হেলান দিলাম।
হ্যাঁ, সত্যিই চলে গেছে। আজকের রাতটা কোনমতে পার করতে পারলেই আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
দুশ্চিন্তার কিছু নেই মানে? শুক্লপক্ষ শেষ হতে তো এখনও অনেক দেরি। পূর্ণিমা হবে। তার পরদিন কৃষ্ণপক্ষ শুরু হলে মানুষটা আর মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হবে না, তাই না?
হ্যাঁ।
তাহলে আসবে না কেন?
অনেকখানি এগিয়েছি। কাল রাতের আগেই ওটাকে খুঁজে বের করে ধরে ফেলব আমি।
কিন্তু আমি ধরতে যেতে চাই না! চেঁচিয়ে উঠলাম। আমি কাল বাড়ি যেতে চাই!
এবার সত্যি সত্যি একটা মায়ানেকড়ে ধরতে পারব আমি! আমার কথা যেন কানেই ঢোকেনি বাবার।
কাজটা খুবই বিপজ্জনক, বাবা, আমি বললাম।
বিপজ্জনক? মাথা নাড়ল বাবা। দিনের বেলা মায়ানেকড়ের কোন ক্ষমতা থাকে না, রবিন। আমাদের মতই স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হয়।
বাবা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? আমি তোমার তাঁবুতে খুঁজে পাইনি। তারপর পায়ের শব্দ শুনে তুমি ভেবে পিছু নিয়েছিলাম।
ঘুম আসছিল না। গড়াগড়ি করতে করতে বার বার মনে হচ্ছিল, চাঁদ উঠেছে। নিশ্চয় এখন শিকারের সন্ধানে বেরিয়েছে মায়ানেকড়ে। তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম। যাকগে, দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে তুমি এখন। ঘুমোও।
খাট থেকে উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে তাঁবুর বাইরে পা রাখল বাবা। ফিরে তাকিয়ে বলল, ভালমত একটা ঘুম দাও, সকালে দেখবে ঝরঝরে হয়ে গেছে শরীর। আগামীকাল অনেক কাজ, পরিশ্রম করতে হবে। আমার ধারণা, একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে আমাদের জন্য।
বাবা পর্দাটা ছেড়ে দিতেই ঝাঁকি দিয়ে সরে এসে আবার ঝুলতে লাগল ওটা।
শুয়ে পড়লাম। কম্বলটা টেনে দিলাম গলার কাছে। জোরাল বাতাস টান দিয়ে দিয়ে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে দিতে চাইছে।
দুলন্ত পর্দাটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তাঁবুটা তাঁবু না হয়ে ঘর, আর পর্দাটা পর্দা না হয়ে দরজা হলে ভাল হতো, তালা লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
ধূর, এরচেয়ে যদি গ্রামে দাদুর বাড়ি যেতাম, কত ভাল হত! চোখ বুজলাম।
গ্রীনহিলসে বাসায় থাকলেও ভাল হতো। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারতাম।
ঘুম ঘুম লাগছে এখন।
স্কুলের এই ছুটিটা শেষ হয়ে গেলেও বাঁচতাম! আমার স্কুল কামাই হবে ভেবে বাধ্য হয়ে মায়ানেকড়ে খোঁজা বাদ দিয়ে বাসায় চলে যেত বাবা।
এ রকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
তবে ঘুমটা গাঢ় হলো না। বিছানায় ছটফট, গড়াগড়ি করতে করতে আবার দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলাম।
পালাচ্ছি…অন্ধকারে আমি পালাচ্ছি, একটা হিমশীতল বনের ভিতর দিয়ে।
রাস্তায় এসে পড়া ডালের নীচ দিয়ে ছুটছি।
আকাশে পূর্ণ চাঁদ। জানোয়ারের মত চারপায়ে ভর দিয়ে ছুটে। চলেছি আমি।