তারমানে…তারমানে আপনিই সেই সন্ন্যাসী, যিনি অহঙ্কারী লোকটাকে মায়ানেকড়ে বানিয়েছিলেন? মনে মনে জিজ্ঞেস করলাম।
মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালেন ব্র্যাডম্যান। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন আমার না-বলা প্রশ্ন। বললেন, পরে আবার সারিয়েও তুলেছি। প্রচুর শাস্তি হয়েছে ওর। পূর্ণিমার পর এসে আমার হাতেপায়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করল। অনেক করে ক্ষমা চাইবার পর ওকে ওই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছি।
এগিয়ে এসে ব্র্যাডম্যানের দুই হাত চেপে ধরলেন মিস্টার মিলফোর্ড। প্লিজ, আপনি আমার ছেলেকে ভাল করে দিন! প্লিজ!
ভূতপ্রেত নিয়ে কারবার করা খুব বিপজ্জনক, মিস্টার মিলফোর্ড। কোনমতেই মায়ানেকড়ে ধরতে যাওয়া উচিত হয়নি আপনার। ভাগ্যিস, রবিনকে আমি বনে দেখে ফেলেছিলাম। ওকে ভাল লেগে গিয়েছিল। আমার চোখে না পড়লে মস্ত ক্ষতি হয়ে যেত ওর। যাই হোক, ওকে আর রেনকে আমি সারিয়ে তুলব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
কিন্তু গ্রীনহিলসে যে মায়ানেকড়ের উৎপাত হচ্ছে আপনি জানলেন কী করে?
টেলিভিশনে দেখে, ব্র্যাডম্যান জবাব দিলেন। খবরটা দেখে আর। এক সেকেন্ডও দেরি করিনি। পরের প্লেনটাই ধরেছি।
কাজটা করতে কোনও উপকরণ লাগবে?
সব আছে। শুরু করছি, তবে তার আগে কথা দিতে হবে আপনাকে, জীবনে আর এ-সব বিপজ্জনক কাজ করতে যাবেন না।
আরও করি? একবারে শিক্ষা হয়নি?
বেশ, আসুন এখন। আমাকে হেল্প করুন। মেঝেতেই বসে পড়লেন ব্র্যাডম্যান। কালো ব্যাগ খুলে তা থেকে তার জিনিসপত্র বের করতে শুরু করলেন।
প্রথমে তিন রঙের তিনটে চক দিয়ে চক্র আঁকলেন তিনি। তাতে বড় একটা তারা আঁকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ডাকলেন, রবিন, এসো। বোসো এই চক্রের ভিতর।
আমার ভিতর কোথায় যেন একটা আক্রোশ মতো তৈরি হচ্ছে। বিদ্রোহ করতে চাইছে মগজ।
ঝট করে একটা শিকড়ের টুকরো আমার দিকে উঁচু করে ধরলেন অকালটিস্ট। কঠিন দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন, জলদি এসো! শয়তানি করে লাভ হবে না! এসো! এসো বলছি!
সেই চোখের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। শিকড়ের টুকরোটা যেন চুম্বকের মত টেনে নিয়ে চলল আমাকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। চক্রটার ভিতর ঢুকে তারাটার ওপর দাঁড়ালাম।
আমার মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে কীসব পড়তে শুরু করলেন ব্র্যাডম্যান।
ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি…
হঠাৎ দেখি, ব্র্যাডম্যান ঘরে নেই। আমি সেই আগের মত বসার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। রেন খাঁচায় আটকানো। বাবা আমার দিকে পিছন ফিরে কাকে ফোন করছে। বোধহয় পুলিশকে।
উঁহু, আর সুযোগ হাতছাড়া করব না। আঁপিয়ে পড়লাম বাবার কাঁধে।
চমকে উঠল বাবা। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। হাত থেকে খসে পড়ল রিসিভার।
তারপর দেখি, রাস্তা দিয়ে চারপায়ে দৌড়ে চলেছি আমি আর রেন। বাবা পিছন পিছন আসছে। মানুষই আছে। মায়ানেকড়ে হয়নি এখনও।
দুটো মায়ানেকড়ের গর্জনে জেগে উঠল আমাদের প্রতিবেশীরা। ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠল। আতঙ্কিত হয়ে তারা দেখল, রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে দুটো মায়ানেকড়ে আর একজন মানুষ। ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন মানুষটা।
থেকে থেকেই গর্জে উঠছে মায়ানেকড়ে দুটো।
রাতের ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে দৌড়ে চলেছে।
দৌড়ে চলেছে উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার মধ্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাবাও মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে।
এভাবেই সমস্যাটার সমাধান করেছি আমি। জেলে যাওয়া ঠেকিয়েছি।
শহরের পাশে যে বন আছে, সেই বনটাই এখন আস্তানা হবে আমাদের।
তবে খুব বেশিদিন আমাদেরকে লুকিয়ে থাকতে হবে না, জানি। খুব শীঘ্রি আমাদের তিনজনের কামড়ে আরও অনেকে মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে। তারাও কামড়াবে। মানুষ, পশু, যাকে পাবে তাকেই। সারা শহরে একটা প্রাণীও আর স্বাভাবিক থাকবে না। পুলিশও না।
দেখতে দেখতে এক আজব শহরে পরিণত হবে আমাদের শহরটা।
মায়ানেকড়ের শহর!
বনে ঢুকলাম। দেখি, নেকড়েতে গিজগিজ করছে বন। কিন্তু ওরা কেউ আমাদের বন্ধু হলো না। আমাদের দেখেই কামড়াতে এল।
আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম।
শীত করতে লাগল। ভীষণ ঠাণ্ডা। কাঁপুনি উঠে গেছে…
ঘোর কেটে গেল। চোখ মেলে দেখি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছি। আমার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছেন মিস্টার ব্র্যাডম্যান। আমাকে চোখ মেলতে দেখে হাসলেন। ফিরে তাকালেন পাশে বসা বাবার উদ্বিগ্ন। মুখের দিকে। বললেন, মিস্টার মিলফোর্ড, ও ভাল হয়ে গেছে। নিয়ে গিয়ে ওকে ওর ঘরে শুইয়ে দিন। কম্বল দিয়ে ভালমত ঢেকে দেবেন। তাহলেই কাঁপুনি বন্ধ হয়ে যাবে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। নাস্তার টেবিলে বাবা জানাল, ব্র্যাডম্যান চলে গেছেন। রেনকে সুস্থ করে নিয়ে গেছেন ব্র্যাটভিয়ায়। বলে গেছেন, ভয় নেই, আর কখনও মায়ানেকড়ে হব না আমি।