মায়ানেকড়ের মুখ থেকে লাঠিটা সরিয়ে আনল একজন। জালটা। সরাল আরেকজন। খাঁচার মেঝেতে পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল। মায়ানেকড়েরূপী মানুষটা। আবার মানুষ হয়ে গেলে দড়ি খুলে দেয়ার কথা ভাবছে নিশ্চয় বাবা।
আরও শক্ত একটা খাঁচা জোগাড় করতে হবে তোমার জন্য, রবিন। দরজা লাগিয়ে তালা আটকে দিল বাবা। ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
পুলিশ চলে গেলে আমি ঘরে ঢুকলাম।
রেন, তুমি! হাঁ হয়ে গেছে বাবা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দুটো মায়ানেকড়ে! এতদিন একটা ধরতে পারছিলাম না, আর এখন আমার বসার ঘরে দু-দুটো মায়ানেকড়ে! আমি কী জেগে আছি?
লাফ দিয়ে আমার কাছ থেকে সরে গেল বাবা।
মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। মৃদু গরগর করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমি তার কোন ক্ষতি করব না।
গুড, মোলায়েম স্বরে বাবা বলল। এ রকম শান্ত হয়ে থাকো। তাহলে কিছু করব না।
চেয়ারে বসল বাবা। আমার দিকে তাকাল আবার। খাঁচার মায়ানেকড়েটার দিকে তাকাল। আবার আমার দিকে ফিরল।
সরি, বিড়বিড় করল বাবা। আর কোন উপায় নেই আমার। তোমাদের দুজনকেই পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে।
ঝট করে মাথা উঁচু করলাম। বলে কী বাবা? যা বলছে, সত্যি সত্যি করবে সেটা?
সারা শহরে মানুষ, এতজনের জীবনের ঝুঁকি নিতে পারি না আমি। একজনকে সামাল দেয়াই কঠিন, দুজনের দায়িত্ব নিতে পারব না।
না! পুলিশের হাতে ধরা দেব না! কিছুতেই না! ভাবলাম।
আমি সত্যি দুঃখিত, বাবা বলল। সারাটা জীবন একটা মায়ানেকড়ে ধরার স্বপ্ন দেখেছি আমি। এ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারিনি। ভুল করেছি, মস্ত ভুল। তার খেসারত এখন দিতেই হবে আমাকে। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল বাবা।
মত বদলেছে বাবা। আমাদের নিজের কাছে রাখতে চাইছে না আর। কিন্তু আমি তার ছেলে। নিজের ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চায়। মানতে পারছি না কোনমতে মত তাকে বদলাতেই হবে।
লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল বারা। পায়চারি করতে করতে বলল, কী করতে হবে বুঝে গেছি। সব ঠিক হয়ে যাবে! কথাটা বলে যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিতে চাইল। যত বড় বড় ডাক্তার আছে, সবার কাছে যাব। ওঝার কাছে যাব। পীর-ফকির-দরবেশ, সবার হাতেপায়ে ধরব।
হ্যাঁ! আমি জানি! বাবা যে একটা উপায় বের করবেই, জানি। নিজের ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবে না।
এ-সব কিছুর জন্য আমি দায়ী, বাবা বলছে। সব দোষ আমার। আমি মায়ানেকড়ে ধরতে না গেলেই আর এই বিপদে পড়তে হত না। তবে এক হিসেবে ভালই হলো। তোমার সঙ্গে সঙ্গে রেনকেও হয়তো ভাল করতে পারব। দুজনকে জেলের ভিতর বন্দি করে রেখে ডাক্তার-বৈদ্যের খোঁজে দুনিয়া চষে ফেলব আমি! তোমাদের সুস্থ করে তারপর আমার শান্তি।
টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল বাবা। থাবা দিয়ে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। হ্যালো! থানা? আমি, রজার মিলফোর্ড। আমার ঘরে এখন দুটো মায়ানেকড়ে। লোক পাঠান। এখুনি নিয়ে যাক।
একত্রিশ
কোন ডাক্তার আমাদের ভাল করতে পারবে কিনা, নিশ্চিত নই। করতে না পারলে অকারণেই সারাটা জীবন জেলের ভিতর কাটাতে হবে। সেটা আমি পারব না। সারাজীবন খাঁচায় আটকে থাকতে রাজি নই আমি। তারচেয়ে বাবাকে ঠেকাই, যাতে আমাদেরকে পুলিশের হাতে দিতে না পারে।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ও এখানেই আছে, টেলিফোনে বাবা বলছে।
রেনের দিকে তাকালাম। পা ছুঁড়ে দড়ি খোলার চেষ্টা করছে। বাবার কথা সে-ও শুনেছে। আমার মতই নিশ্চয় সারাজীবন খাঁচায় আটকে থাকতে রাজি নয়। গর্জন করে উঠল। হাঁ করা মুখের ফাঁকে লালা লেগে থাকা বড় বড় দাঁতগুলো চকচক করে উঠল।
ওর দাঁতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুদ্ধিটা মাথায় এল। কী করতে হবে বুঝে গেছি।
যা করার এখুনি করতে হবে। আমাদের দুজনের সমস্যার। সমাধান।
বাবার সাহায্য আমাদের দরকার হবে। তাকে দিয়েই খাঁচার তালাটা খোলাতে হবে।
আর সেটা করাতে হলে বাবাকেও আমাদের দলে আনতে হবে। মায়ানেকড়ে বানাতে হবে।
লাফ দিয়ে বাবার গায়ে পড়তে যা, ঠিক এই সময় দরজার কলিং বেল বাজল।
খুলে দিল বাবা।
বাইরে থেকে শোনা গেল, এটা কি মিস্টার রজার মিলফোর্ডের বাড়ি?
আমি রজার মিলফোর্ড, বাবা বলল। আপনি?
আমি সেক্সটন ব্র্যাডম্যান, জবাব শোনা গেল। ভিতরে আসতে পারি? জরুরি কথা আছে।
আসুন, সরে পথ করে দিল বাবা।
একটা কালো ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকলেন একজন মধ্যবয়েসী ভদ্রলোক। গায়ে আলখেল্লা। চোখ দুটো কালো, চকচকে। লম্বা লম্বা। পায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে।
চেনা চেনা লাগল তাঁকে। ওই আলখেল্লা, ওই চোখ, কোথায় দেখেছি?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল। বনের ভিতর! ব্র্যাটভিয়ার বনে তাঁবুতে ঢুকে যে মানুষটা আমাকে অলৌকিক ক্ষমতাশালী দাঁত দিয়েছিলেন, ইনি সেই লোক, কোন সন্দেহ নেই।
আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন, দাঁতটা গলা থেকে খুললে কেন? বেনকে বাঁচাতে? সেজন্যেই তো অশুভ চিন্তা মাথায় ঢুকছে। এক্ষুনি তো তোমার বাবাকে কামড়ে দিতে যাচ্ছিলে।
আপনি…আপনি…বাবা বলল।
নাম তো বললামই। আমি একজন অকালটিস্ট। ভূতপ্রেত, ভ্যাম্পায়ার, মায়ানেকড়ে নিয়ে কারবার আমার, ওদের নিয়ে গবেষণা করি। ব্র্যাটভিয়ার বনে অনেক দিন থেকেছি। রবিন যে সাপুড়ের কেবিনে ঢুকেছিল, ওটা আমিই বানিয়েছিলাম।