আমিও একইভাবে পাল্টা হুমকি দিলাম।
ঊনত্রিশ
এদিকে! এই রাস্তায়! একজন পুলিশ অফিসারের চিৎকার শোনা গেল। মায়ানেকড়ের ডাক শুনলাম বলে মনে হলো।
মনে হচ্ছে ওই বাড়িটার পিছন থেকে আসছে! বাবার গলা। শুনলাম। কোনমতেই যেন পালাতে না পারে!
এসে গেছে পুলিশ। ঘিরে ফেলবে এখন, বুঝতে পারলাম।
মায়ানেকড়েটার দিকে তাকালাম। কান খাড়া করে ফেলেছে। ওটা জ্বলন্ত চোখ ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছে। লুকানোর জায়গা খুঁজছে।
এখন ওকে সাহায্য করব কী করে?
কী করে বাঁচাব?
আবার মানুষরূপে ফিরে এলেই কেবল বাঁচতে পারবে ও। ছোট্ট একজন টাকমাথা মানুষকে দেখলে কেউ ভয়ঙ্কর প্রাণী ভেবে গুলি চালাবে না।
রাইফেলে বাবার গুলি ভরার দৃশ্যটা কল্পনা করলাম। সত্যি কী রূপার বুলেট মায়ানেকড়ে মেরে ফেলে?
মায়ানেকড়ে থেকে মানুষ হওয়ার উপায় কী?
ভাবো! ভাবো! নিজেকে তাগাদা দিলাম।
হ্যাঁ! মনে পড়েছে।
মায়ানেকড়েকে মানুষরূপে ফিরিয়ে আনতে চাইলে তার নাম ধরে ডাকতে হয়।
সেটা করতে পারি।
ওর নাম আমি জানি।
কাজ হবে তো? পরীক্ষা করে দেখা যাক।
মায়ানেকড়েটা আমার দিকে ফিরে তাকাল। আমিও ওটার জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
রেন! চেঁচিয়ে উঠলাম। হিউগ রেন!
কিন্তু আমার মায়ানেকড়ের মুখ দিয়ে শব্দগুলো শুধু ঘোঁতঘোত হয়ে বেরোল।
কিছুই ঘটল না।
দুজন দুজন করে যাও, অফিসার-ইন-চার্জের গলা শোনা গেল। ভালমত খোজো।
মায়ানেকড়েকে মানুষে রূপান্তরিত করার আরও একটা উপায়। আছে। সেটা কী?
রাতের আকাশকে চিরে দিল সাইরেনের শব্দ।
ঠিকমত ভাবতে পারছি না।
ভাবো, রবিন! ভাবো!
হ্যাঁ! পেয়েছি!
মায়ানেকড়ের মাথায় তিনবার থাবা দিলে ওটা মানুষ হয়ে যায়।
কিন্তু থাবা দেব কীভাবে? এক জায়গায় তো স্থির থাকছে না।
শব্দ শুনলাম মনে হলো! একজন অফিসারের গলা কানে এল। কাছাকাছিই আছে!
আর সময় নেই।
লাফ দিয়ে এগিয়ে গেলাম মায়ানেকড়েটার কাছে।
ওটা কিছু বোঝার আগেই পা উঁচু করে মাথায় থাবা মারতে লাগলাম।
একবার। দুবার। তিনবার। তারপর লাফিয়ে সরে গেলাম। কই? কিছুই তো ঘটল না। গর্জে উঠল মায়ানেকড়েটা। জ্বলন্ত চোখে তাকাল আমার দিকে।
এদিকে, মিস্টার মিলফোর্ড! একটা উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল। ঠিকই বলেছেন, ওই বাড়িটার পিছনে!
ভারি জুতোর শব্দ ছুটে এল রাস্তা দিয়ে। কী করা যায়? কী করা যায়? হঠাৎ মাথায় এল বুদ্ধিটা।
আমার গলায় ঝোলানো দাঁতটা থাবার সাহায্যে খুলে আনলাম। আঙুল নেই, তাই থাবা থেকে ফসকে পড়ে গেল মাটিতে।
নখ দিয়ে বহু কষ্টে তুলে নিয়ে মায়ানেকড়েটার গলায় ঝুলিয়ে দিলাম।
ঠিক এই সময় সেখানে এসে হাজির হলেন একজন পুলিশ অফিসার।
চোখের পলকে একটা ঝোপে ঢুকে পড়লাম। অফিসারের চিৎকারে তার দলবল এসে হাজির হলো।
বরফের মত জমে গিয়ে যেন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ানেকড়েটা। আতঙ্কিত। কোণঠাসা। হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে।
রাইফেল তুলল পুলিশেরা।
আমি গুলি করছি! একজন অফিসার বললেন।
আতঙ্কে পাথর হয়ে যেন তাকিয়ে আছি। ট্রিগারে চেপে বসল অফিসারের আঙুল। তারপর গুলি ফোঁটার প্রচণ্ড শব্দ।
ত্রিশ
ঝটকা দিয়ে আকাশের দিকে উঠে গেল রাইফেলের নল। অফিসার ট্রিগার টেপার আগের মুহূর্তে ঠেলা দিয়ে নৃলটা ওপরের দিকে তুলে দিয়েছে বাবা। কারও কোন ক্ষতি না করে শূন্যে উঠে গেল বুলেট।
গুলি করবেন না! পরক্ষণে শোনা গেল বাবার চিৎকার। ওটা আমার ছেলে!
ঝোপের ভিতরে লুকিয়ে থেকে মুচকি হাসলাম। আমার মায়ানেকড়ের মুখে হাসিটা কেমন দেখাল জানি না। দাঁত বদলের বুদ্ধিটা কাজে লেগেছে। বাবা ভাবছে ওটা আমি। রেনের জীবন বাঁচল।
মায়ানেকড়েটাকে ঘিরে ফেলল পুলিশ। জাল ছুঁড়ে আটকে ফেলল। কয়েকজনে মিলে চেপে ধরল মাটিতে। একনাগাড়ে গর্জন। করছে মায়ানেকড়েটা। কামড়ানোর চেষ্টা করছে। জালের ভিতরে শরীর মোচড়াচ্ছে।
আড়ালে থেকে আমি সবই দেখছি। মনে মনে প্রার্থনা করছি, প্লিজ, ওর কোন ক্ষতি করবেন না, ক্ষতি করবেন না!
পা ছুঁড়ছে মায়ানেকড়েটা। ধস্তাধস্তি বন্ধ করছে না। নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু জালে আটক থেকে এত লোকের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না।
জালের মধ্যে রেখেই মোটা দড়ি দিয়ে ওটার পা বেঁধে ফেলা হলো। ছটফট করছে শুধু এখন মায়ানেকড়েটা। চাপা গোঙানি বেরোচ্ছে গলা দিয়ে।
আমার মায়ানেকড়ের চোখ দিয়ে অন্ধকারেও ওর চোখের বিষণ্ণতা দেখতে পাচ্ছি। ও বুঝে গেছে, পরাজিত হয়েছে। তবু শেষবারের মত নিজেকে মুক্ত করার জন্য মস্ত হাঁ করে কামড়ে দিতে চাইল একজন পুলিশের হাতে।
জালের ফাঁক দিয়ে ওর হাঁ করা মুখে লাঠি ঢুকিয়ে দিল একজন। লাঠির দুই মাথা ধরে মাথাটাকে মাটিতে চেপে ধরল।
সাবধান, ব্যথা দেবেন না! উদ্বেগে কাঁপছে বাবার গলা। পরাজিত প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে। কী করে আবার খাঁচা থেকে বেরোল ও, বুঝতে পারছি না। আমি কথা দিচ্ছি, আর এমন ঘটনা ঘটবে না।
আবারও বাবার অনুরোধ রাখল পুলিশ। মায়ানেকড়েটাকেসহ বাবাকে গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিল।
পুলিশ চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর সাবধানে, ছায়ায় গা ঢেকে বাড়ি ফিরে এলাম।
বসার ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম।
এটা তোমার দোষ নয়, রবিন। তুমি তো আর ইচ্ছে করে মায়ানেকড়ে হতে যাওনি। মোলায়েম- স্বরে বলতে বলতে মায়ানেকড়েটাকে খাঁচায় ভরছে বাবা। তাকে সহায়তা করছে কয়েকজন পুলিশ।