কীসে আঁচড় কাটছে দেখতে যেতে ভয় লাগছে। মায়ানেকড়ে না।
এই, যা যা! ধমক দিলাম। যা, পালা! আমাকে একটু ঘুমোতে কিন্তু গেল না ওটা! হাঁটু কাঁপছে আমার।
শান্ত হও, রবিন, নিজেকে বোঝালাম। কীসে কাটছে, দেখো আগে। মায়ানেকড়ে না-ও হতে পারে। হয়তো অন্য কিছু। বনে তো জন্তু-জানোয়ারের অভাব নেই।
ঘেমে গেছে হাতের তালু। শার্টে ডলে মুছলাম। ভারী দম নিলাম। উঠে দাঁড়ালাম। আমি দাঁড়াতেই আঁচড়ের শব্দ থেমে গেল। চলে গেল নাকি ওটা? দরজার দিকে এগোলাম। পর্দা ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিলাম। আঁচড়ের শব্দটা যেখানে হচ্ছিল, সেদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখলাম না।
ঘন গাছপালায় ছাওয়া বন। অন্ধকার আকাশের পটভূমিতে লম্বা গাছগুলোকে কালো দেখাচ্ছে। তিন দিন আগে এই বনে এসেছি বাবার সঙ্গে। আর প্রতি রাতেই মায়ানেকড়ের ভয়ানক দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরছে আমাকে।
সত্যিই কী মায়ানেকড়ে আছে এই বনে?
তাঁবুর পর্দা আরেকটু ফাঁক করলাম। মাথা আরেকটু বের করলাম বাইরে। চারপাশে তাকালাম। নাহ্। কোন প্রাণী চোখে পড়ল না। নিশ্চয় আমার ওঠার শব্দ শুনে চলে গেছে।
ছোট্ট একটুকরো খোলা জায়গায় তাঁবু ফেলেছে বাবা। সন্ধ্যাবেলা তাঁবুর সামনে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলেছিল। ছাইয়ের নীচে ধিকিধিকি আগুন রয়ে। গেছে বোধহয় এখনও। সাদা ধোয়ার ফিতে সাপের মত এঁকেবেঁকে উঠে যাচ্ছে।
বাবার তাঁবুটার দিকে তাকালাম। কোন শব্দ নেই ভিতরে। আঁচড়ের শব্দও সেই যে থেমেছে, আর হচ্ছে না। বাইরে পা রাখলাম।
গাছের পাতায় বাতাসের মৃদু সরসর ছাড়া পুরো বনটাই নীরব। কনকনে ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠলাম। মুখ তুলে তাকালাম চাঁদের দিকে।
আমার তাঁবুর কাছ থেকে আরেকটু সরে এলাম। কান পেতে আছি।
কোন শব্দ নেই আর। নিশাচর জানোয়ার, পেঁচার ডাক, কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
ভূতুড়ে নীরবতা। আবার লাফানো শুরু করল হৃৎপিণ্ডটা।
বাবা বলেছে, এই অভিযানে আসার দুটো কারণ। এক, একটা মায়ানেকড়ে ধরা। আর দুই, মায়ানেকড়ে সম্পর্কে আমার ভয় দূর করা। বাবা মনে করে, ছেলেদের এত ভীতু হওয়া উচিত নয়।
যাই হোক, বাবার একটা উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। মায়ানেকড়েও ধরতে পারেনি, আর আমারও ভয় দূর হয়নি। বরং এখন এই বন। থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।
আবার তাকালাম চাঁদের দিকে। বাবা আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, একা একা রাতে কখনও বাইরে বেরোবে না। এই বনে
মায়ানেকড়ে আছেই। তা ছাড়া এখন শুক্লপক্ষ। চাঁদের আলোয় মায়ানেকড়েরা শিকার ধরতে বেরোবেই।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আবার লাফানো শুরু করেছে হৃৎপিণ্ডটা। আমার বুকের খাঁচায় যেন হাতুড়ি পিটানোর শব্দ করছে।
নিজের তাঁবুতে যেতে ভয় লাগছে। একা একা আর ঘুমাতে পারব না। বাবার তাঁবুতে থাকব ঠিক করলাম। তবে ভয় পেয়েছি, এ-কথা বলা যাবে না। বলতে হবে আমার পেটে ব্যথা।
বাবার তাঁবুর কাছে এসে আস্তে পর্দা সরিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম। বাবা? বাবা!
জবাব নেই। তাঁবুতে নেই বাবা।
চার
পিছনে খসখস শব্দ হলো। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকালাম। কান পেতে শুনছি।
বনের মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতা মাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। ভারি পায়ের শব্দ।
নিশ্চয় বাবা আসছে! ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক, কাছাকাছিই রয়েছে বাবা। হাঁটতে লাগলাম শব্দ লক্ষ্য করে।
ছোট্ট খোলা জায়গাটা থেকে এসে বনে ঢুকলাম। একটা সরু পায়েচলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চললাম। চাঁদের আলো পথ দেখাচ্ছে। আমাকে।
বাবাকে ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না। কাছাকাছি মায়ানেকড়ে থাকলে আমার ডাক শুনে চলে আসবে। ভালুকও আসতে পারে। শুনেছি, মানুষের মাংসেও অরুচি নেই ব্র্যাটভিয়ার ভালুকের।
শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না ঠিক কোনখান থেকে আসছে শব্দটা।
একটা দো-রাস্তার মুখে এসে পড়লাম। কোনদিকে যাব এখন? সোজা সামনে, যেটা দিয়ে এগোচ্ছি? নাকি পাশেরটা?
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পায়ের শব্দ। দূরে চলে যাচ্ছে। মনে হলো, পাশের রাস্তাটা ধরেই যাচ্ছে।
সেটা ধরে দৌড়ানো শুরু করলাম। ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়লাম বনের আরও গভীরে। গাছপালা অনেক ঘন এখানে। কালো পর্দা তৈরি করে যেন আকাশ আড়াল করে দিয়েছে গাছের মাথা। চাঁদের আলো ঢুকতে দিচ্ছে না।
অন্ধকারে পথ না দেখায়, হোঁচট খাচ্ছি। গাছের ডাল সড়াৎ সড়াৎ বাড়ি খাচ্ছে নাকেমুখে। আর না ডেকে পারলাম। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, তুমি কোথায়?
সাড়া এল না। থেমে গিয়ে কান পাতলাম। কোথাও কোন শব্দ নেই আর এখন।
এত নীরব হয়ে গেল কেন বনটা? গায়ে কাঁটা দিল আমার। মনে হচ্ছে সব অবাস্তব, একটা মস্ত দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছি।
হঠাৎ মট করে শুকনো কুটো ভাঙার শব্দ হলো। নিশ্চয় বাবা!
শব্দ লক্ষ্য করে দৌড় দিলাম। মোড় নিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। রাস্তা। গাছের বড় বড় ডাল এসে পড়েছে রাস্তার ওপর, অনেক নিচুতে, সেগুলো পার হতে গিয়ে বার বার মাথা নিচু করতে হচ্ছে আমাকে। গাছের পাতা থেকে কুয়াশা পানি হয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে মাথায়।
দম নিতে, থামলাম আবার। নাহ্, বাবাকে আর খুঁজে পাব না! এত অন্ধকার, কিছুই দেখা যায়। কোথায় চলেছি, তা-ও জানি না।
বাবা! বাবা! কোথায় তুমি? মায়ানেকড়ের কানে যাবার ঝুঁকি নিয়েও চিৎকার করে ডাকলাম।